বর্তমান সঙ্কটের দায় কাদের? by হারুন-আর-রশিদ

১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্তের প্রথম দিনেই একটি টিভি চ্যানেলে রাত ১০টায় টকশোতে যা দেখলাম তাতে মনে হলো, একটি গ্রাম্য ঝগড়াÑ সুস্থ মস্তিষ্কধারী জ্ঞানী মানুষের কথাবার্তায় এত উগ্রতা কখনো দেখিনি। দেখিনি অনুষ্ঠান সঞ্চালকের এমন দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডÑ নীরবে তিনি সদাহাস্যমুখে তা উপভোগ করছেন। মনে হচ্ছিল, সঞ্চালকারিণী একটি দলের পক্ষে ভূমিকা নিয়ে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন। পক্ষপাত-আক্রান্ত এসব অনুষ্ঠান জাতির ভাগ্যাকাশে আরো বিপর্যয় ডেকে আনবে। মাননীয় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল ওই অনুষ্ঠানে তিনিই একক বক্তা, অন্য বিশিষ্টজনেরা তার ছাত্র। অনুষ্ঠানটির যবনিকাপাত ঘটেছে অনেকটা এভাবেÑ সব দোষ নন্দঘোষের। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত দেশে যা ঘটেছে বা ঘটছে তার সব দোষ বিএনপির। মন্ত্রীর পুরো বক্তব্যই অনুষ্ঠানে প্রাধান্য পেয়েছিল। একপর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা অব: মেজর জেনারেল ইবরাহিমের সাথে সঞ্চালককে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। ভাষা প্রয়োগে অসুস্থতার পরিচয় দিয়েছেন সঞ্চালক। এভাবে পক্ষপাত রোগে আক্রান্ত প্রচারযন্ত্র থেকে দেশ ও জাতির অপকারই বেশি হবে, যদি এভাবে চলতে থাকে। জাতির দর্পণ হলো গণমাধ্যম, সেখানেও যদি দেশের মানুষ সত্য কথাটি খুঁজে না পায়, তাহলে দেশের জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনবে।
দেশে হরতাল-অবরোধ এবং সহিংতার ব্যাপকতা কেন বাড়েÑ সেই প্রসঙ্গে একটি লেখায় বলেছিলাম। এসবের মূল কারণ অনেকটা প্রকৃতির মতো। মানুষ যখন প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করে তখন প্রকৃতি বসে থাকে না, রুদ্রমূর্তি ধারণ করে; এতে দেশ ও জনগণের চরম ক্ষতি হয়। ঝড়, বন্যা, গোর্কি, ভাঙন এবং অতিমাত্রায় তাপদাহ ও ঋতুচক্রের আমূল পরিবর্তনÑ এসবই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে আচরণের কারণেই এসব দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তদ্রƒপ গণতন্ত্রও। কারণ তার আদর্শ আছে, নীতি আছেÑ যখন এর বিরুদ্ধাচরণ করা হবে, তখন গণতন্ত্র তার স্বাভাবিকরূপে আর থাকবে না, বিকৃত উগ্ররূপ ধারণ করবে। বর্তমানে সেটাই ঘটছে। কিন্তু দুঃখজনক যে, রাজনীতিকেরা মূল কথাটি বুঝতে চাইছেন না। ক্ষমতার মসৃণ পথ হলো গণতন্ত্র। সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনে সেই গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হয়। কিন্তু ৫ জানুয়ারির ২০১৪ জাতীয় নির্বাচনটি সেই আলোকে হয়নি। জোটগতভাবে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির এক অংশ ছাড়া দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং সংশ্লিষ্ট জোট সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ ছাড়া দেশের আরো ২০ থেকে ২৫টি দল অংশগ্রহণ করেনি। কেন করেনি, সেটা এ দেশের মানুষ যেমন জানে, তেমনি জানেন রাজনীতিকেরাও। নবম সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগে সংবিধান থেকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সর্বসম্মত ও পরীক্ষিত বিধানটিকে উৎপাটন করার কারণে আজকের এই সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সঙ্কট। এটা কোনোভাবেই আইনশৃৃঙ্খলাজনিত ঘটনা নয়। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার কারণ, গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথকে রুদ্ধ করে দেয়ার ফলে প্রথাগত নিয়মে গণতন্ত্র আর সোজা-সরল থাকেনি। গতিহারা গণতন্ত্র যে অন্য রূপ নেবে রাজনীতিসচেতন মানুষ তা সহজেই বোঝে।
এবার সঙ্কটের অবতারণা ঘটে গুলশানের ৮৬ নম্বর বাড়িতে ট্রাক বোঝাই বালুর বস্তা দ্বারা ৩ জানুয়ারি প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের পথকে অবরুদ্ধ করে দেয়ার দিন থেকে। একইভাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পথকেই শৃৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছে। মিটিং, মিছিল, মানববন্ধনসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো সরকারি নির্দেশে। সেই কঠোর নির্দেশ এখনো বহাল আছে। আফসোসের বিষয়, বিএনপি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় থেকে তখনকার বিরোধী দলের দাবি মোতাবেক (আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি) তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি ১২তম সংশোধনী এনে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে দলটি। সেই মানদণ্ডে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক বেশি সহনশীল রাজনৈতিক দল। আজ বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের দাবিÑ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ন্যক্কারজনক হলো, বৃহত্তর বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সব রকম মিটিং, মিছিল, কর্মসূচি চলছে অবাধে। গণমাধ্যমে তা পুরোপুরি প্রচার করার সুযোগ পাচ্ছে। গণতন্ত্র শুধু বিশেষ দলের জন্য নয়, সব দলের মতপ্রকাশের অধিকারের নামই গণতন্ত্র। একপেশে কথিত গণতন্ত্রের ব্যবহার সহিংসতার বিকাশ ঘটায়। পেট্রলবোমা থেকে শুরু করে গুম, ক্রসফায়ার, ডাইরেক্ট গুলির হুকুমসহ যত রকম সহিংসতার পথ, সবই গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথকে রুদ্ধ করে দেয়ার কারণেই ঘটছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা লিড নিউজ লিখেছেÑ ২০ দলের আজ বিক্ষোভ। পুলিশ বিএনপিকে রাস্তায় নামতে দেবে না। বাধা দিলে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বাত্মক হরতাল। মাঠে থাকবে শুধু আওয়ামী লীগ। পুলিশ তাদেরকে সহযোগিতা করবে সহিংসতা দমনে। গণতন্ত্রকে কারা বাধাগ্রস্ত করছে এবং কিভাবে করছে পত্রপত্রিকায় তা প্রতিদিনই প্রকাশ পাচ্ছে। এর নাম কী করে গণতন্ত্র হয়? এ দেশে আইয়ুব শাহীর শাসনামলেও মত প্রকাশে এত বাধা দেয়া হয়নি। আরেকটি দৈনিকে (১৪-২-১৫) এসেছে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, জাতীয় সংলাপের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করলে অসাংবিধানিক শক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। ওই পত্রিকায় লিড নিউজ ছিল গুলশানের ৮৬ নম্বর বাড়িতে ভাত ও পানিকষ্টে তারা ৫৬ জন, পঞ্চম দিনের খাবারও নিয়ে গেছে গুলশান পুলিশ। একটি দৈনিকে (১৪-২-১৫) লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী যদি নিজে ঘোষণা দেন, সহিংসতার পথ বন্ধ করলেই আমার দল সংলাপে বসতে রাজি। কিন্তু সে ধরনের কোনো আলামত সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে আসছে না। ফলে গণতন্ত্র আলোর পথ দেখছে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ ফেব্রুয়ারির একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট মানবৃষ্ট দুর্যোগ। মূলত পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর একক সিদ্ধান্ত মানব সৃষ্ট এ দুর্যোগের কারণ। প্রায় দুই মাস ধরে যে সহিংসতা চলছে তার গোড়ার কারণ ক্ষমতাসীন সরকারের সীমাহীন ক্ষমতার দাপট। তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্য কথা বলার ন্যূনতম সুযোগ পর্যন্ত রাখেননি। তাদের চরম দমন-পীড়নে বিরোধী দল জনগণের চোখের সামনে থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে বলা চলে। অনেকেই বলছে, বিএনপি এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। তাদের বেশির ভাগ নেতাই কারাগারে। বাকিরা গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রশ্নটা হলো, বিএনপি এখন কী করবে। রাস্তায় বের হতে পারছে না। কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারছে না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের বাধার কারণে। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে শুনেছি, মানুষ মারা বন্ধ করতে হলে ভোট দিতে হবে। আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। যত দিন নির্বাচন না হবে তত দিন অচলাবস্থা হয়তো থাকবে। এই সহজ কথাটি কেন প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন না। ৫ জানুয়ারি একপেশে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। তারা সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন চায়। সব দল-সমর্থিত একটি স্থায়ী ব্যবস্থা নির্বাচনকালে থাকতে হয়। সেরকম একটা আইনি ব্যবস্থা দলিল আকারে সবার সম্মতি নিয়ে করতে হবে। অন্যথায় নির্বাচনের পর স্থূল কারচুপি, সূক্ষ্ম কারচুপি, ভোটারবিহীন নির্বাচন, ভোটকেন্দ্রে দলীয় সন্ত্রাস, এসব কথা প্রতি পাঁচ বছর পর পর শুনতে হবে। জনগণই ক্ষমতার উৎস, সেহেতু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো বিষয়ে দ্বিমত বা বহুমত দেখা দিলে, তখন মতগুলোর ওপর গণভোট নেয়া হলে কলহ-বিবাদ ও সহিংস রাজনীতি থেকে দেশবাসী রেহাই পাবেন। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতার একটি স্থায়ী ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তাবিধানে অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
পেট্রলবোমা ও বালুর ট্রাক দুটোই আমাদের অসুস্থ ও দূষিত রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। বালুর ট্রাক মানুষ না মারলেও পেট্রলবোমার রাজনীতি কার্যত পেপার স্প্রে ও বালুর ট্রাক থেকে সৃষ্ট। দেশের বৃহত্তম দলের প্রধান ব্যক্তির মুখ বন্ধ করে দেয়া গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাঠে নামার মতো বিষয় এবং প্রতিবন্ধকতার প্রতীক, যেটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোথাও নেই। বিএনপি যতই চেষ্টা করুক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে সরকার এখন তা হতে দেবে না। এজেন্টরা আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে নিয়ে যাবে আর এভাবে সহিংসতার অভিযোগে নেতাদের পাইকারিভাবে গ্রেফতারের সুযোগ মিলবে। প্রথম থেকে বোমাবাজির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ বিএনপি করতে পারেনি বলে এ ক্ষেত্রে সরকারের কৌশলের কাছে হেরে গেছে।
ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়Ñ এই ‘থিম’ রাজনীতিকেরা স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু দলগতভাবে এই নীতি কেউই অনুসরণ করেন না। দলীয়করণ ছাড়া বড় দুটো দল বিগত ২৪ বছর সরকার পরিচালনা করতে পারেনি। সেহেতু নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির কথা সুবিবেচনায় এনে সব রাজনৈতিক দলকে (নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত) একটি জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করতে হবে। এ সনদই হবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত। কাজটি করতে হবে যাতে বিজয়ী দল দেশ পরিচালনায় স্বৈরাচার বা পরিবারতন্ত্র বা জমিদারিব্যবস্থা চালু করতে না পারে। সে কথা সনদে উল্লেখ থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে একক ক্ষমতা দিয়ে সম্পূর্ণ নির্দলীয় লোকদের কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে। ধর্মগ্রন্থ নিয়ে তাদের শপথ গ্রহণ করতে হবে। দেশকে যারা ভালোবাসেন তাদের এগিয়ে আসতে হবে এসব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় মতামত দেয়ার জন্য। উন্নত বিশ্বের সংবিধানে এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত বিধান আছে বিধায় নির্বাচনোত্তরকালে ওই সব দেশে সহিংসতা দেখা দেয় না।
১৫ ফেব্রুয়ারি একটি পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য পড়ে ভাবলাম, বিএনপি আর ঢাকায় মিটিং-মিছিল করতে পারবে না। সে পথ সরকার ২০১৯ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ মিছিলটি সরকার করতে দেয়নি। বৃহত্তম বিরোধী দল থেকে আভাস দেয়া হয়েছিল যদি সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা না দেয়, তাহলে বিএনপি হরতালের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকবে। সরকারের আচরণে মনে হলো, সরকারও বুঝি হরতাল চায়। পুলিশ প্রশাসন আগে থেকেই তাদের মিছিল করতে না দেয়ার ঘোষণা দেয়। প্রশাসন ৫ জানুয়ারির আগে থেকেই বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের ওপর বিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছিল, এটি এরই ধারাবাহিকতা বলে প্রতীয়মান হয়। মহানগর পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করতে চাইলেও অনুমতি দেবো না। কারণ আমাদের আস্থা নেই। স্পষ্টতই এ মনোভাব অযৌক্তিক এবং সঙ্ঘাতের রাজনীতির উসকানি। আইনের রক্ষক হিসেবে পুলিশ সরকারি ও বিরোধী দল নির্বিশেষে সবার প্রতি সমান আচরণ প্রদর্শন করবেÑ এটাই জাতির প্রত্যাশা।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক
E.mail : harunrashidar@gamil.com

No comments

Powered by Blogger.