সব পরিস্থিতিতে সব কিছু গ্রহণযোগ্য নয় by এবনে গোলাম সামাদ

সব পরিস্থিতিতে সব কিছু গ্রহণযোগ্য নয়। শোক প্রকাশও নয়। বিশেষ করে শোকের প্রাণহীন সমারোহ। যাতে থাকে না কোনো আবেগের প্রণোদনা। কেবলই থাকে আনুষ্ঠানিকতার প্রগলভতা। একজনের পুত্র মারা গেলেন। মা তার পুত্রশোকে হয়ে পড়েছেন প্রায় বাকহীন। এ অবস্থায় আরেকজন তাকে সমবেদনা জানাতে যেতেই পারেন। এভাবেই চলেছে আমাদের সমাজজীবন। মৃত্যু সব পরিবারেই আসে। এক পরিবার আরেক পরিবারকে জানাতে চায় সমবেদনা। সমবেদনা দুঃখকে করে তোলে সহনীয়। কিন্তু এটা সাধারণ জীবনে খাটলেও রাজনীতিকদের জীবনে যে খাটে, তা বলা যায় না। বিশেষ করে যাদের মধ্যে চলেছে আদর্শিক ও মতার দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্ব বিরোধিতার স্তর ছেড়ে পৌঁছেছে প্রায় শত্র“তার মাত্রায়। বেগম জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান অকালেই মারা গেলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে কিছু না জানিয়েই ছুটে গেলেন সমবেদনা জানাতে। কিন্তু বেগম জিয়া চাইলেন না অথবা পারলেন না এই আনুষ্ঠানিকতাকে গ্রহণ করতে। আমরা দেখলাম, এক দিকে শেখ হাসিনা ছুটে গেলেন শোক প্রকাশ করতে, অন্য দিকে একই সাথে শুনলাম তার দলের নেতাদের খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করার কথা বলতে। কেবল দলের নেতারাই নয়, উচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও বলতে দেখা গেল, প্রমাণ মিললেই খালেদাকে গ্রেফতার করা হবে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এভাবে রাজনৈতিক ধাঁচে কথা বলতে পারেন বলে মনে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে পারেন। গণতন্ত্রে আমরা জানি, রাষ্ট্র ও সরকারকে এক করে ফেলা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে। রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোনো দল অথবা জোট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার লাভ করে থাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। চিরকালের জন্য নয়। এছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ, যথা আইনসভা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে চেষ্টা করা হয় পরস্পরের থেকে পৃথক রাখার। যাতে করে, এদের একটি বিভাগ আর একটি বিভাগের মতার অপব্যবহারকে প্রশমিত করতে পারে। গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের ধারণা অতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এ েেত্র খুবই ঘাটতি। গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্যে প্রয়োজন হয় জনমত, রাজনৈতিক দল এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু জনমত গঠনের েেত্র সৃষ্টি করা হচ্ছে বাধা। বিরোধী দলের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনকে দেয়া হচ্ছে বন্ধ করে। দেয়া হচ্ছে না, রাজনৈতিক দল গড়ার অবাধ সুযোগ। আর অবাধ নিরপে নির্বাচন এ দেশে হতে পারছে না। তাই দেশে শুরু হয়েছে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। খালেদা জিয়া হয়ে উঠেছেন এই আন্দোলনের প্রতীক। তিনি একজন সাধারণ নাগরিক নন। তাই তার পুত্রের মৃত্যুতে শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করতে যাওয়াকে মনে হতে পেরেছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর এই কারণেই হতে পারেনি খালেদা জিয়ার সাথে শেখ হাসিনা সাাৎকার। এটা নিয়ে হইচই করার কিছু নেই। ইতিহাসে এটা বিরল ব্যাপারও নয়। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সভায় কে বা কাহারা করেছিল গ্রেনেড হামলা। এতে নিহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন মহিলা। যার মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমানের (পরে রাষ্ট্রপতি) স্ত্রী আইভী রহমান। বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজে শেখ হাসিনা কিছু দিনের জন্য হয়ে পড়েছিলেন বধির। খালেদা জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী। তিনি শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু শেখ হাসিনা তার সাথে দেখা করতে জানান অস্বীকৃতি। বেগম জিয়া জিল্লুর রহমানের সাথে দেখা করতে চাইলে, জিল্লুর রহমান আপত্তি করেন না। এই জন্য জিল্লুর রহমানকে আওয়ামী লীগের মধ্যে হতে হয়েছিল সমালোচিত। ল করার বিষয়, জিল্লুর রহমানের সাথে সাাতের আগে খালেদা জিয়া নিয়েছিলেন তার যথাযথ সম্মতি। হঠাৎ করেই তিনি ছুটে যাননি তার কাছে। খালেদা জিয়া বজায় রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল। কিন্তু শেখ হাসিনা সেটা করেননি। তিনি জানতে চাননি, শোকসন্তপ্ত খালেদা জিয়া তার সাথে সাাৎ করবেন কি না। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যদি দুইজনেই হতেন সাধারণ মহিলা, তাহলে দুইজনের মধ্যে সমবেদনা সহজেই গ্রহণযোগ্য হতে পারত। কিন্তু রাজনীতির প্রাচীর সেটা হতে দেয়নি।
রাজনীতি আর সমাজনীতি এক নয়। প্রখ্যাত ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক মন্তব্য করেছেন (বাংলাদেশে প্রতিদিন, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৫) হেলায় সুযোগ নষ্ট করল বিএনপি। কিন্তু কিসের সুযোগ? শেখ হাসিনা কোনো আপসরফা করতে যে গিয়েছিলেন, তা ভাবার কারণ নেই। তিনি তারেক রহমানকে বিলাত থেকে ফেরত এনে বিচার করতে চাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে তারেক রহমানের প্রাণদণ্ড। ব্রিটেন তারেক রহমানকে ফেরত দেবে কি না বলা যাচ্ছে না। কেননা, বিলাতের আইনে এখন আর প্রাণদণ্ড নেই। প্রাণদণ্ড হতে পারে এমন কাউকে তারা ফেরত দিতে রাজি নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে সমবেদনার প্রশ্ন বিশেষভাবেই অবান্তর। তবে অনেক বুদ্ধিজীবীই মনে করছেন, খালেদা জিয়া দিয়েছেন ধৃষ্টতার পরিচয়। এসব বুদ্ধিজীবী রাজনীতির ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞাত নন। ব্রিটেন নেপোলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দী করে রাখে। প্রাণদণ্ড প্রদান করে না। কিন্তু খাদ্যের সাথে অল্প অল্প আর্সেনিক মিশিয়ে তাকে খেতে দিয়ে ধীরে ধীরে মেরে ফেলে। নেপোলিয়নের চুল কাটতেন যে নাপিত, তিনি তার কোনো বন্ধুকে নেপোলিয়নের কিছু চুল উপহার দিয়েছিলেন। তার এই চুল নিয়ে অনেক পরে হয়েছিল গবেষণা। আর তার এই চুলের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল আর্সেনিকের পরিচয়। খাদ্যের মধ্যে আর্সেনিক থাকলে তা চুলে গিয়ে জমতে পারে। অনেক কিছুই ঘটে রাজনীতির কারণে। নেপোলিয়নকে বিষ প্রয়োগ করেন মারার ঘটনাও এর মধ্যে একটি। বলা হচ্ছে, বিএনপি নেত্রীর হুকুমে তার অনুসারীরা যাত্রীবাহী বাসে ছুড়ে মারছে পেট্রলবোমা। খালেদা জিয়া এই অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তার ওপর চাপানো হচ্ছে বিশেষ অভিযোগ। মানুষ পুড়িয়ে মারা কেউ সমর্থন করে না। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, যুদ্ধের আইন আর শান্তির আইন এক নয়। তা যদি হতো, তবে জাপানের ওপর পরমাণু বোমা নিপেকে বিবেচনা করা হতো একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধ হিসেবে। কিন্তু সেটা করা হয়নি। পারমাণবিক অস্ত্র যারা বানিয়েছেন তাদের মধ্যে আটজন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কিন্তু তাদের বিবেকে বাধেনি এ রকম নরঘাতী অস্ত্র নির্মাণে। সাধারণ পটকা ফুটালে তাকে ধরা হচ্ছে সন্ত্রাসী হিসেবে; কিন্তু পরমাণু বোমা নিপেকে কেউ সন্ত্রাসবাদী কর্ম বলে চিহ্নিত করতে চাচ্ছে না। আক্রান্ত হলে মানুষের মধ্যে দুই রকম প্রেরণা দেখা দিতে পারে। কেউ ভয়ে পালানোর উদ্যোগ নিতে চাই, আবার কেউ চায় মরণপণ লড়াই করতে। তাদের সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করা যায় না। এ দুনিয়ায় শান্তিপূর্ণ যুদ্ধ বলে কিছু হওয়া সম্ভব নয়। আমি আমার ছাত্রজীবনে ধর্মঘটের ওপর লেখা একটি বই পড়েছিলাম। তাতে বলা হয়েছিল, ধর্মঘটে কারো-না-কারো তি হবেই। যে ধর্মঘটে কারও তি হয় না, সে ধর্মঘট সফল হয় না। এ হলো ধর্মঘটের দর্শন।
আমরা শান্তি চাই। কিন্তু অশান্তির কারণগুলোকে বজায় রেখে শান্তি আসতে পারে না। শান্তি আসতে হলে আওয়ামী লীগকে আসতে হবে আলোচনার টেবিলে। আজকের বাস্তবতা এই কথাই বলে। ঢাকায় থাকি না। টেলিভিশনে দেখলাম আরাফাতের নামাজে জানাজা হতে। যে বিরাট জনসমাগম এই নামাজে জানাজায় হতে পেরেছে, তাকে বলা চলে না ভাড়া করে আনা। মানুষের ঢল নেমেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অনেক পত্রিকায় লেখা হচ্ছে, দেশের লোক নাকি বিএনপির হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বহু মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করছে। আর বিএনপি একটি জনসমর্থনহীন দল নয়।
অনেক পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, ঢাকার বাইরে বারোটি জেলায় জামায়াতে ইসলামী করছে আন্দোলন। কিন্তু ঢাকাতে আরাফাত রহমানের নামাজে জানাজায় যে জনসমাগম হতে দেখলাম, তা কি কেবলই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক? তা যদি হয়, তবে বলতে হবে খালেদা জিয়া শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেও আন্দোলন মাঝপথে থেমে যাবে না। জামায়াতে ইসলামের নেতৃত্বে তা হতে থাকবে পরিচালিত। আর তাই আওয়ামী লীগকে শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতায় আসতে হবে জামায়াতে ইসলামীর সাথে। তাদের রাজাকার বলে দূরে সরিয়ে রেখে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আসবে না। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতে হবে রাজনৈতিকভাবেই।
দেশে ঠিক কী হতে যাচ্ছে আমরা তা জানি না। কিছু দিন আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে। অনেক ব্রিটিশ এমপি মনে করেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক গোলযোগ চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত সেনাশাসন এসে যেতে পারে। সেনাশাসন এলে, এ দেশে বর্তমান দুই নেত্রীর রাজনীতিতে ছেদ পড়া সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে ঠিক কী চায় তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্কিন সিনেটে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যথাযথ হয়নি। এতে প্রতিফলন ঘটেনি জনমতের। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে প্রকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। মাত্র ক’দিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা এসেছিলেন ভারত সফরে। তিনি কেন ভারত সফরে এসেছিলেন আমরা তা জানি না। তবে একটি মত হলো, তিনি ভারতে এসেছিলেন চীনকে সংযত করার ল্েয। চীন ও ভারতের মধ্যে অরুণাচল নিয়ে একটি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। সেটাকে ঠেকানোই হলো ওবামার ভারত সফরের ল্য। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে, চীন ভারত কোনো যুদ্ধ শুরু হলে সে-ও জড়িয়ে পড়তে পারে এই যুদ্ধের মধ্যে। বাংলাদেশে যদি একটি জাতীয় নির্বাচন হয়, তবে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। আর তার পে অনেক সহজ হবে এই জটিল পরিস্থিতিতে যথেষ্ট মনোবল নিয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। জাতিক এবং আন্তর্জাতিক উভয় কারণেই এখন বাংলাদেশে হওয়া উচিত কোনো দলনিরপে সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও নিরপে নির্বাচন।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.