ট্রলারে মানব পাচার- ৩০০ জনের সিন্ডিকেটের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে by মহিউদ্দীন জুয়েল

দেশের মানব পাচারে সারা দেশে রয়েছে ৩০০ জনের একটি বিশেষ সিন্ডিকেট। গত ১৪ বছরে ২০ হাজার মানুষ মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে। লোক পাচারের সিন্ডিকেটে জড়িত রয়েছে মিয়ানমার কোস্টগার্ডের সদস্যরাও। ভাল চাকরির লোভে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে লাশ হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। স্বল্প সময়ে লাখপতি থেকে কোটিপতি হওয়ার ইচ্ছা তাদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশা সমুদ্রে। খপ্পরে পড়ছে ভয়ঙ্কর দালাল চক্রের। সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়া নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের হেডকোয়ার্টার গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে নিয়ে গঠিত এ কমিটি চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। এতে কক্সবাজারের সংসদ সদস্য বদি ও তার ভাইসহ অনেক প্রভাবশালী মহলের নাম রয়েছে। পুলিশ জানায়, দেশের বাইরে থাইল্যান্ডে বসে নেতৃত্ব দিচ্ছে মানাকিং নামের মালয়েশীয় এক নারী। বাংলাদেশে রয়েছে মংমং সেন রাখাইন। এ মংমং সেন রাখাইন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ৭ জনের মধ্যে ৩ নম্বরে থাকা ইয়াবা কারবারি। ১৩ই ডিসেম্বর কক্সবাজার পুলিশ তাকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে। মমসী নামে পরিচিত এ কারবারি বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিবেদনটি তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় দেড় মাস। এতে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে টেকনাফ দিয়ে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে লোক পাচার শুরু হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে। গত ৫ বছরে সাগর দিয়ে অবৈধভাবে পাচারের সময় ২ হাজার ৭৩৩ জনকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি। আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৩৫৫ জনকে। বিদেশে অবৈধ পথে লোক পাঠিয়ে কোটিপতি হয়েছে দেশের শীর্ষ ২৬ হুন্ডি ব্যবসায়ী। গত ৫ বছরে এসব ব্যক্তির অনেকের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি। গোপনে মোটা অংকের সুদের মাধ্যমে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা লোক পাঠাতেন সিঙ্গাপুর, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে। এসব ব্যবসায়ীদের ধরতে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশ।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, তালিকায় উল্লেখ করা শীর্ষ হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মধ্যে  টেকনাফের জালিয়াপাড়ায় জাফর আলম ওরফে টিপি জাফর, একই এলাকার জাফর সাদেক, শাহপরীর দ্বীপের হেলাল উদ্দিন, ফাইসাল, আবদুল্লাহ, মো. জামাল, সাবরাংয়ের হারুন, আবদুস শুক্কুর, টেকনাফ পৌরসভার ইসলাম, হামিদ হোসেন, সাবরাংয়ের মুফিজুর রহমান, টেকনাফের আবু বক্কর, নাইট্যংপাড়ার আবু বক্কর, টেকনাফ পৌরসভার নুরুল আবসার, ঢাকার গুলশানের জুবাইর হোসেন, চট্টগ্রামের খুলশীর পিচ্চি আনোয়ার, ইসলাম, কক্সবাজারের আবদুল্লাহকে হন্য হয়ে খুঁজছে পুলিশ। মূলত এরা খুবই দুর্ধর্ষ এবং শক্তিশালী বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।
তবে অভিযুক্তদের মধ্যে টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়ার মংমং সেন কারাগারে রয়েছে। সেখানে বসেই সে আবার নেতৃত্ব দিচ্ছে বিদেশে মানবপাচারের। অন্যদিকে ইসলাম নামের যে ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে তিনি টেকনাফ পৌরসভার সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই ও পৌরসভার প্যানল মেয়র-১ মুজিবুর রহমানের প্রধান সহযোগী বলে লেখা হয়েছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা এতটাই শক্তিশালী যে তারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে ফেলে। বিভিন্ন ঘটনায় তাদের নাম উঠে আসলেও তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। গোয়েন্দা পুলিশের অনুসন্ধানে জানা যায়, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নির্দেশ অনুযায়ী দেশের ৪১টি জেলা থেকে লোক সংগ্রহ করে তাদের দালালরা। আর সমুদ্রপথে ৬০টি পয়েন্টে ট্রলারে পাচারের জন্য নিয়োজিত থাকে তাদের একাধিক সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশী, থাইল্যান্ড ও মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে থাকা কিছু অসৎ লোকজনের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে হুন্ডি ব্যবসার নেটওয়ার্ক। এরা কৌশল হিসেবে লোক পাচার করে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের অদূরে ৯০ ডিগ্রি বামে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ায় তাদের সম্পদের পাশাপাশি পরিবর্তন হয়েছে বাড়িঘরের চিত্রও। প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক তলা ভবনের মালিক। নামে বেনামে, স্ত্রীর নামে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের একাধিক জমিজমা রয়েছে। রয়েছে কোটি টাকার গাড়িও। টেকনাফ পৌরসভার সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই ও পৌরসভার প্যানল মেয়র-১ মুজিবুর রহমানের প্রধান সহযোগী ইসলাম হুন্ডি ব্যবসা করে কক্সবাজারে বেশ প্রতিষ্ঠিত। অথচ এক সময় তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। এসব ব্যক্তিদের প্রত্যেকের ব্যাংক একাউন্টে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবৈধভাবে হুন্ডি ব্যবসা করে তারা এখন কোটিপতি। যেভাবে টাকা জমা হয়েছে তা খুবই অস্বাভাবিক।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা তৈরি করে আমরা ঢাকায় হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়েছি। সেখানে ২৬ জনের নাম রয়েছে। এসব ব্যক্তিরা কয়েক কোটি টাকার মালিক। অবৈধভাবে লোক পাঠিয়ে এরা মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করতো। তিনি আরও বলেন, দু-একজন ধরা পড়ে এখন কারাগারে। বাকিদের বেশির ভাগই পলাতক। আমরা তাদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শুনেছি দেশের বাইরেও তাদের পরিবারের লোকজনের মাধ্যমে তারা হুন্ডি ব্যবসা করে। বিষয়টি পুলিশের হেডকোয়ার্টারকে জানানো হয়েছে। অভিযুক্তদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.