আঁধার by ওয়াসি আহমেদ

পাহড়ের এ জায়গাটা খুব উঁচুতে না হলেও খোলামেলা। দৃষ্টি কিছুটা কাত করে ঢেলে দিলে কত দূরে যে চলে যায়, গুটিয়ে আনাই যেন মুশকিল। দিনের পর দিন ঝোপঝাড়ের আড়ালে কাছিমের খোলের মতো তার নিজের ছোট কুঠুরিতে থেকে থেকে সে যেদিন এ জায়গাটা আবিষ্কার করল, ভাবল মাঝেমধ্যে এসে বসা যাবে। আসাটাসা হয়নি। প্রথম যেদিন এসেছিল, তারপর এই দ্বিতীয়বার এখানে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের স্মৃতিই তার মনে জাগল। তাকিয়ে থাকলে চোখজোড়া যে কত দূরে চলে যায়! পাহাড়জুড়ে যখন রাবার-বাগান হবে, তখন গাছ-ফাছ ধুমসে কেটে সাফ করার পর হয়তো চোখজোড়াকে এভাবে ছেড়ে দেওয়ার কথা কেউ ভাববে না। আবার ভাবতেও পারে। সে আগেভাগে কী করে জানে ভাববে না! তবে এই যে এখন তাকিয়ে কূলকিনারা পাচ্ছে না আর এমনও যে মনে হচ্ছে একবার চোখ খুলে নজরটাকে ছড়িয়ে বিছিয়ে দিলে আবার গুটিয়ে আনা মুশকিল, এ নিশ্চয় কারও মাথায় খেলবে না। প্রায় দুই বছর হয়ে গেল সে এখানে। যারা তাকে বসিয়েছে, তারা তাকে পরখ করে জানতে চেয়েছিল, পারবে তো? সে হেসেছিল। এমন একটা জায়গা তার দরকার ছিল। আশপাশে জনমানুষ নেই, পাহাড়িদের বসতিগুলোও দূরে দূরে, ছাড়া-ছাড়া। বসতির দিকে সে যায় না। সপ্তাহে একটা হাট বসে, সে-ও ম্যালা দূরে। তবে দরকারি জিনিসপাতি মেলে। তেল-পেঁয়াজ-নুন, জাত-বেজাতের পাহাড়ি আলু, সবজির মধ্যে কাঁচকলা, কাঁকরোল। এত কাঁকরোল যে কেন এখানে ফলে, এ এক রহস্য। পারবে কি না, জানতে চাওয়ার জবাবে তার হাসিটুকু ওদের পছন্দ হয়েছিল। মনে মনে তারা নিশ্চয় বলেছিল, না পারলেও পারতে হবে। এমন জায়গায় তাকে কেউ খুঁজে পাবে না। আসল কথা, তার যে এরকম জায়গাই দরকার এটা সে যেমন জানত, ওরাও জানত।
আসার সময় সঙ্গে আনার মধ্যে এনেছিল গামছায় পেঁচানো পুরোনো, দু-এক জায়গায় জংধরা রামদা। অন্য কিছুর কথা ভাবেনি; এত বড় পাহাড়-জঙ্গল, তবে বাঘ-ভালুক যখন নেই, দরকারের হাতিয়ার দরকারই জোগাবে। দূরে, চোখের জ্যোতিটা যেখানে গিয়ে আর পারছে না, নিস্তেজ হয়ে পড়ছে, সেদিকে ঢালু দৃষ্টিটাকে স্থির রেখে তার মনে হলো ঝাপসা টলোমলো টানা লম্বা রেখার মতো একটা কিছু এই ধরা পড়ছে, এই না। নদী িক? ভাবামাত্র সে বুঝল আবোলতাবোল চিন্তা করছে, এখানে নদী আসবে কী করতে! নাটাইয়ে সুতা গোটানোর মতো সে একটু একটু করে তার নজরটাকে আস্তে আস্তে টেনে তুলতে লাগল। খেলাটা ভালো লাগছে। যত টানছে, নতুন নতুন জিনিস তাজা-টাটকা ধরা পড়ছে। ছোট-বড় ঝোপঝাড়, লাল মাটির ন্যাড়া টিলা, পাতা খসা একটা দেবদারুগাছের মাথায় কুচকুচে কলপ দেওয়া এক পাল ময়না। টেনে টেনে দৃষ্টিকে আঁটো করতে গিয়ে মনে হলো ঢাল থেকে চড়াই ভেঙে চোখ দুটোর উঠে আসতে কিছুটা যেন মেহনত করতে হচ্ছে। নাটাইয়ের কাছাকাছি ঘুড়ি চলে এসেছে এমন সময় তার নজরে অন্য রকম কিছু ধরা দিল। গাছপালা না, পশুপাখি না, একটা মানুষ। কোনো ভুল নেই মানুষই। সে যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে বড়জোর ২০ কদম ঢালুতে একটা কাঁটাঝোপের পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দেখামাত্র তার প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়া হলো, সেটা তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক—এখনি কেটে পড়া উচিত। কিন্তু একটা খটকাও মগজে তোড়পাড় জুড়ল। এমন জায়গায় লোকটা এল কী করে! মেরেই বা কারা রাখল! টাটকা লাশ, গলা-পচা গন্ধ নেই। কেটে পড়বে ভেবেও সে কী ভেবে ঢাল ভাঙতে নিচের দিকে পা বাড়াল। একনজর দেখা যেতে পারে, এর বেশি সে চিন্তা করেনি।
এতক্ষণ তাকে অনামা রাখলেও এবার তার একটা নাম দেওয়া যেতে পারে। আসল নাম গোপন রেখে ধরা যাক তার নাম সুরুজ। সাবধানে নামতে গিয়েও ঢালে পা রাখতে সুরুজের প্রায় গড়িয়ে পড়ার দশা হলো। উপুড় লোকটা যে পুরোপুরি মাটিতে পড়ে আছে তা না। নিচু একটা গাছের মাটি ছুঁই ছুঁই ডালে তার বুক-পিঠ আটকে আছে, কোমর থেকে নিচটা মাটিতে। ওপর থেকে দেখে সুরুজ এত কিছু ঠাওর করতে পারেনি। লোকটার পরনে মেটে রঙের ফুল প্যান্ট, পায়ে ভারী বুট, গায়ে গাঢ় লাল গেঞ্জি। উপুড় অবস্থায় যতটা নজরে পড়ে, গায়ে রক্তের দাগ-টাগ নেই। সুরুজ এ সময় অনেকটা যেন না চাইতেই কাজটা করে ফেলল। দুই পা সামনে এগিয়ে ডালে আটকানো বুক-পিঠ ছাড়িয়ে লাশটাকে চিত করে শোয়াতেই সে চমকালো। মরা-ঠান্ডা লাশ না, গা গরম, শ্বাস-প্রশ্বাসে বুক-পেটের ওঠা-নামা মৃদু হলেও বোঝা যাচ্ছে। লোকটার কপালে জখম, বাঁ চোখের ওপরে কালচে কাড়ি-বাঁধা রক্ত। গুলির কথা মনে হলেও সুরুজ সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দিল। গুলি খাওয়া কপালে রক্ত অনেক বেশি ঝরত, এর তো সারা শরীরে, এমনকি নাকেমুখেও রক্তের ছিটেফোঁটা নেই। বাঁ ভ্রুর ওপরে ইঞ্চি তিনেক মাত্র জায়গায় ছেতরানো শুকনা রক্ত। সুরুজ যা বোঝার বুঝল। ছুটতে গিয়ে গাছে ঠোকর খেয়েছে? আরও যা আন্দাজ করল, এমনি এমনি ছুটবে কেন, ধাওয়া খেয়ে জান নিয়ে পালাতে গিয়ে...। কিন্তু সুরুজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছে? লাশ হলে কথা ছিল, একনজর দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল।
এ যে জ্যান্ত, মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিলে এতক্ষণে চোখ খুলত। ঠান্ডা পানির দরকার হলো না, চিত করে শোয়ানোয় শ্বাস টানার সুবিধা পেয়েই হয়তো লাল গেঞ্জির মুখ দিয়ে একটা কাতরানোর আওয়াজ উঠল। সুরুজ নড়তে চাইলেও কেন যেন পারল না। বরং যা সে একদমই ভাবেনি তা-ই করে বসল। মাটিতে বসে লোকটার মাথা কোলে তুলে হাত দিয়ে, যেন হাতটা অন্য কারও, বুকে আস্তে আস্তে চাপ দিতে লাগল। অল্প কিছুক্ষণ, লোকটা চোখ খুলল। খুব যে চমকে উঠল খুলে তা-না। সুরুজ দেখল, বয়সে তারই কাছাকাছি—চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে। চোখ বন্ধ অবস্থায় মনে হয়েছিল অনেক কম। বার কয়েক সুরুজের চোখে তাকিয়ে সে কোল থেকে মাথা তুলে বুকে হাত চেপে উঠে বসতে চাইল। ইচ্ছাটা জোরালো, যেন পারলে শরীর ঝাঁকিয়ে এক লাফে উঠে সুরুজের গলা চেপে ধরে! বুকে হাত চেপে সে উঠতে পারল না, সুরুজ তখন পিঠের দিক থেকে ঠেলা দিতে কাজ কিছুটা হলো। উঠে বসল বটে, কিন্তু পরপরই সুরুজের গায়ে নিজের ভর ঠেকিয়ে এলিয়ে পড়ে রইল। সুরুজ তখন পরিষ্কার খেয়াল করল লাল গেঞ্জির চোখে-মুখে ভয়। পারল না যে উঠতে তা শরীরের ব্যথা-বেদনার চেয়ে ভয়ের কারণেই। সারাটা সকাল লাল গেঞ্জিকে নিয়ে সুরুজের গেল। সুরুজ কিছু জানতে না চাইতেই সে জানিয়েছে আগের রাতে জঙ্গলে ছুটতে ছুটতে তার আর কিছু মনে নেই।
কুঠুরি পর্যন্ত দূরত্ব কম না, তাও যদি পাশাপাশি পা ফেলে দুজন হাঁটতে পারত! কাঁধে ফেলে বয়ে নিতে হয়নি, তবু ধরে ধরে থেমে থেমে এগোতে গিয়ে সুরুজের মনে হচ্ছিল পথ ফুরাবে না। শেষ পর্যন্ত কুঠুরিতে যখন পৌঁছা গেল, লোকটাকে সুরুজ তার নিজ হাতে গড়া চার পায়ায় শুইয়ে ঘড়াভর্তি পানি দিয়েছিল খেতে। কপালের রক্ত মুছতে গিয়ে সুরুজ তার আগের ধারণায়ই অটল রইল। ঠোকর। অন্ধকারে গাছের সঙ্গে কপালের আন্ধা ঠোকর। লোকটার কপাল—সুরুজ ভাবল, না হলে সকাল-সকাল সে যাবেই বা কেন ওখানে। ঘুরতে ঘুরতে চলে গিয়েছিল। আর চোখজোড়াকে চরিয়ে–ফিরিয়ে এমন যে খেলাচ্ছিল, তাজা-টাটকা লাশ ভেবে এই লাল গেঞ্জির খোঁজ পেতেই! তো লাশটা যখন আর লাশ না, পুরো ঘড়া পানি গিলে অনেকটা তরতাজা, তারপর নেতানো একটা সিগারেট টেনেটুনে সোজা করে মুখে দিয়ে যেই আগুন চাইল, সুরুজ জানল নিজের বিপদ মানুষ এভাবেই ডেকে আনে। তবে এখনো পারে, গামছার পট্টি খুলে রামদার এক কোপে শেষ করে কুঠুরির পেছনের গর্তে ফেলে ধীরেসুস্থে বেলচা মারা। দুই দিন কেটে যেতে লোকটা নিজে থেকেই জানাল যাদের তাড়া খেয়ে জঙ্গলে ঢুকে গাছের সঙ্গে ঢুস খেয়েছে, তাদের একজন এখনো এই জঙ্গলেই আছে। নিশ্চয় আছে, সে জোর দিয়ে বলল, থাকতে তাকে হবেই, কারণ... কারণটা শুনতে সুরুজ কৌতূহলী হলো না। তাহলে সে কেন জঙ্গল পাহারার নামে ঘাপটি মেরে আছে, সে কারণও এসে পড়বে। গোড়াতে পরনের লাল গেঞ্জির কারণে সুরুজ লোকটাকে লাল গেঞ্জি বলে চালিয়ে দিলেও সে নিজে থেকে গায়ে পড়ে বলেছে তার নাম রনি।
আরও বলেছে, যে তাকে এই জঙ্গলে খুঁজে ফিরছে তার হাতে অস্ত্র আছে, বাঁটে নম্বর বসানো সার্ভিস রিভলবার—পুলিশের কোমরে শিকল দিয়ে আটকানো থাকে। সুরুজ তার পরও কৌতূহল দেখায়নি, পুলিশের অস্ত্র কবজা করার কাহিনি জানতে চায়নি। তাহলে তার নিজের বিষয়ও না এসে পারবে না। সে যা-ই হোক, লোকটা, মানে রনি কি তাকে উসকে দিতেই নিজের কথা বলছে, এ কথা ভেবে সুরুজ আরও সাবধান হয়েছে। যদিও সে জানে, রনি তাকে যদু-মধু ভাবছে না। রিভলবারের কথা শুনে সুরুজ মনে মনে হেসেছে, ভয় দেখানো খেলনা, পাকা হাত না হলে পনেরো-বিশ গজ দূরেও টিপ খাটে না। ট্রিগার টেপামাত্র নলটা যে লাফ দেয়, একে বশে আনা যার তার কাজ না। তবে রনির খোঁজে রিভলবারধারী যদি এই কুঠুরির পাত্তা পেয়ে চোরের মতো পা টিপে টিপে দুই-তিন হাত দূর থেকে বুকে তাক করে তাহলে... নিজে সেধে রনিকে তার ডেরায় এনে তুলেছে ঘটনাটা নিজের কাছে যত অবিশ্বাস্যই লাগুক, সুরুজের মনে হয় হয়তো সে ভেতরে ভেতরে একা হয়ে পড়েছিল, নিজের মনের মতিগতিই সে বুঝতে পারেনি। রনির পকেটে টাকা আছে। সেই টাকায় সুরুজ হাট থেকে মুরগি কেনে, খুঁজে খুঁজে গরমমসলা কেনে। রান্নাটা করে রনি। সুগন্ধ-সুবাসে সুরুজের কাছিম খোলের একচালা কুঠুরি কেঁপে কেঁপে ওঠে। মোমবাতির আলোয় মুখোমুখি বসে দুজন পেট ঠেসে খায়। ওঠার মুখে যে প্রশ্নটা রনির আরও আগেই করা উচিত ছিল, করে, ‘তোমার ঘটনা কী?’
শুনতে পায়নি এমনভাবে মুখে ঘড়া উপুড় করে পানি খেতে খেতে সুরুজ জবাবটা নিয়ে ভাবে। রনি যেন তাকে সময় দিতে বলে, ‘তুমি না থাকলে এই খাওয়াটা কপালে থাকত না। বিছরাইয়া পায় নাই, না অইলে তুমিও পাইতা না, পাইতা লাশখান। আইচ্ছা, তুমি কী কামে ওই দিকে গেছিলা? দূর তো কম না।’ জবাবটা বুঝি রনিই তার মুখে তুলে দেয়। ‘আর কাম! লাকড়ি টুকাইতে...’ শোনামাত্র রনি বিষম খায়। হেঁচকি তুলে কাশতে থাকে, আবার সুরুজের জবাবে এমন হাসির খোরাক বরবাদ না করে হাসতে গিয়ে হেঁচকি আর হাসির টক্কর সামলাতে না পেরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায়ও গলায় তার টিটকারি, ‘লাকড়ি...!’ এতটা সুরুজ ভাবেনি। মুহূর্তেই সে টের পায় তার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। সে সময় নষ্ট করে না, এক লাফে রনির বুকে চড়ে ঘড়ঘড়ে গলায় শাসায়, ‘হাসোস ক্যান? গলার রগ ছিঁড়া ফালামু।’ বলে এঁটো হাতে রনির গলা চেপে ধরতে যায়। রনি যেন এর জন্য পুরো প্রস্তুত, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় শরীর মুচড়ে হাতের ধাক্কায় সুরুজকে ছিটকে ফেলে কুঠুরির এক কোণে সরে যায়। সুরুজ কিছুটা হতভম্ব হলেও দেরি করে না, মুরগি কাটা বড়সড় ছুরিটা পড়ে ছিল মেঝেতে। নিমেষে ছুরি তুলে সে এক পা এগিয়েছে কি এগোয়নি, তাজ্জব হয়ে দেখে রনির হাতে তার নিজের সেই রামদা। গামছার আব্রুহীন, এমনকি সদ্য সদ্য পাথরে ঘষে শাণ দেওয়া, জং-এর চিহ্নটিহ্ন নেই। সুরুজকে বাজারে পাঠিয়ে রনি কুঠুরি তন্ন তন্ন করে খুঁজে রামদাটা বের করেছে, শাণও দিয়ে রেখেছে। পেল কী করে? চারপায়ার ভেতরের দিকের তক্তায় পেরেক মেরে আটকে রেখেছিল। রনির গলায় হেঁচকি নেই, তবে মুখে হাসিটা আছে, খিঁ খিঁ ইতরামি হাসি। তাজ্জব হলেও সুরুজ কী করবে! ভরসা একটাই, কুঠুরির নিচু এইটুকু জায়গায় তিন হাত লম্বা রামদা দিয়ে সুবিধা করতে পারবে না রনি। তার চেয়ে তার নিজের হাতের ছুরিটা কাজের। হাত চারেক তফাতে দুজন দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছে কে আগ বেড়ে এগোয়। নিজের ওপর রাগে-ক্ষোভেই হবে সুরুজ এক দলা থুতু ফেলে।
রনি একচুলও নড়ে না। সে নিজেও বুঝতে পারছে এইটুকু জায়গায় রামদার কেরামতি কেবল সুযোগ বুঝে কোপ বসানোয়—যেখানেই হোক, ঘাড়-গলা-মাথায় না হলেও চলবে। কিন্তু নিজে উদ্যোগী না হয়ে ওকে আগ বাড়তে দেওয়াই বুদ্ধির কাজ। হাতে ধরা যার যার হাতিয়ার, কিন্তু চোখগুলো পলকহীন একে অন্যেকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখছে। এমন সময় দূরে বাঁশ ফাটার মতো আওয়াজে দুজনই দুলে উঠল। যেন একই আওয়াজ দুজনকে যার যার মতো নাড়িয়ে দিল। এই ফাঁকে চোখগুলোয় পলক পড়ল, আবার ফের তাকাতে চোখে চোখ, তবে ধার খুইয়ে কিছুটা নড়বড়ে। রনি রামদা ফেলে দিল, যেন ইচ্ছা করলে সুরুজই তাকে মারুক। সার্ভিস রিভলবারের গুলি খেয়ে মরার চেয়ে এই ভালো। এদিকে সুরুজ নিশ্চিত, অবিকল বাঁশ-ফাটা আওয়াজটা রাইফেলের। সে-ও হাত ঝেড়ে ছুরি ফেলে দিল। কয়েক মুহূর্ত দুজন ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। হাত খালি, চোখগুলো মুখোমুখি তাক করা হলেও একে অন্যকে দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। সুরুজ এক ফাঁকে ঘাড় এপাশ-ওপাশ করে তার দুই বছরের সংসার দেখল। একটা নিঃশ্বাস লুটোপুটি খেয়ে নাক পর্যন্ত ধেয়ে আসতে সে বাধা দিল না। নিঝুম কুঠুরিতে নিঃশ্বাসের আওয়াজটা পড়েই মিলিয়ে গেল না, যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে আশপাশের সবকিছুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল। তখন আবার বাঁশ-ফাটা আওয়াজ। সুরুজ জানে রাইফেল। রনি ভাবছে রিভলবার। যার জন্য যা। দুজন যখন কুঠুরি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল, চারদিকে ঘোরঘুট্টি অন্ধকার। যত অন্ধকারই হোক, সুরুজ জানে কোন দিক দিয়ে বেরোতে কম ঝামেলা। খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। এ শালা রাঁধে মারাত্মক। রাতভর হাঁটতে পারলে আপাতত হয়তো ফাঁড়াটা কাটানো যাবে। খুব কষ্ট হওয়ার কথা না, তারা নিচের দিকে যাবে। এগোতে এগোতে একসময় সুরুজ খেয়াল করল, রনি দুই হাতে তার কনুই চেপে হাঁটছে। রাতকানা নাকি? ভূতভূতে অন্ধকারে চোখ দিয়ে কী হবে, পা চললেই হলো।

No comments

Powered by Blogger.