অবরোধ-হরতালে বিচার কাজে বিঘ্ন- বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ by ওয়াকিল আহমেদ হিরন

টানা অবরোধ-হরতালের কারণে উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে। দেশব্যাপী দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপুলসংখ্যক বিচারপ্রার্থী মামলার শুনানির পূর্বনির্ধারিত ধার্য দিনে ঢাকায় এসে হাজিরা দিতে পারছেন না। অনেক মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য থাকলেও একটি পক্ষ আদালতে আসতে না পারায় রায়ের দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচার বিঘি্নত ও বিলম্বিত হচ্ছে। সময়মতো শুনানি না হওয়ায় আদালতে মামলার জট আরও বাড়ছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকে গত ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী টানা অবরোধ শুরু হয়। এর সঙ্গে থেমে থেমে চলছে হরতালও।হরতাল-অবরোধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচার কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে। হাইকোর্ট বিভাগের নিয়মিত ৫০টি বেঞ্চ সচল রাখা যাচ্ছে না। প্রতি হরতালে ৫০টির মধ্যে ৪-৫টি বেঞ্চে বিচার কাজ হচ্ছে। আইনজীবীরা বলছেন, অনেক বিচারপতি নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে এ সময়ে আদালতে আসতে পারছেন না। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রামে-গঞ্জে থাকা অসহায় বিচারপ্রার্থীরা।
ঢাকার নিম্ন আদালতের চিত্রও এক। সেখানকার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধের কারণে জেলা জজ আদালত ও সিএমএম আদালতে বিচারাধীন মামলার সাক্ষী ও আসামিকে যথাসময়ে হাজির করা যাচ্ছে না। ফলে বিচারকরা মামলার শুনানির তারিখ পেছাতে বাধ্য হচ্ছেন। হাইকোর্টের রুলস অনুযায়ী সরকার ঘোষিত সাপ্তাহিকদু'দিন ছুটি, সরকারি ছুটি, আদালতের বার্ষিক ছুটি, গ্রীষ্মকালীন ছুটিসহ চলতি বছর সুপ্রিম কোর্টে ছুটি রয়েছে মোট ১৭৮ দিন। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে ৫৩টি বেঞ্চ রয়েছে। নতুন বছরে ৫ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২৩ দিন হরতাল-অবরোধ হয়েছে। জানা যায়, হাইকোর্ট বিভাগে ৫৩টি বেঞ্চে প্রতিদিন গড়ে নতুন-পুরনো ৪-৫ হাজার মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। গত ২০ দিন টানা অবরোধ থাকায় কাঙ্ক্ষিত হারে মামলার বিচার কাজ হয়নি। এর মধ্যে ৫ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে হাইকোর্ট বিভাগের সব বেঞ্চে এ সময়ে প্রায় এক লাখ নতুন-পুরনো মামলার বিচার কার্যক্রম হতো। হরতাল-অবরোধের কারণে নির্ধারিত রায়, আদেশ ও শুনানির দিন পিছিয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার হরতাল চলাকালে আপিল বিভাগের দুটি বেঞ্চে নিয়মিতভাবে বিচারকাজ হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের ৪-৫টি বেঞ্চে বিচার কাজ হয়েছে। এদিন হাইকোর্টের ২৪ নম্বর বেঞ্চে পিলখানা বিডিআর হত্যা মামলার আপিল শুনানি হয়নি। সোমবার হরতাল চলাকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পৃথক দুটি বেঞ্চ বসলেও হাইকোর্টে মাত্র ৫টি বেঞ্চে বিচার কার্যক্রম চলে। এগুলো হচ্ছে হাইকোর্টের ৩, ৪, ১১, ২৪ ও ৩৩ নম্বর বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে এক নম্বর বেঞ্চে ওইদিন তালিকাভুক্ত প্রায় দুইশ' মামলার শুনানি নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে একটি আদেশেই একশ' মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।অবরোধে গাড়ি ভাংচুর ও আগুন দেওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন এলাকায় দায়ের করা মামলায় বিএনপি ও জামায়াত নেতা-কর্মীরা গ্রেফতারের ভয়ে ঢাকা এসে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনের জন্য আবেদন ও শুনানি করতে পারছেন না। বিচারপ্রার্থীরা ওকালতনামায় স্বাক্ষর এবং ঢাকায় এসে আইনজীবীর সঙ্গে মামলার বিষয়ে শলাপরামর্শও করতে পারছেন না।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সমকালকে বলেন, হরতাল-অবরোধে আদালতের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও কোনো পক্ষ উপস্থিত হতে না পারলে মামলার নতুন তারিখ ধার্য হচ্ছে। তবে বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিতে যেন বিলম্ব না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই মামলার তারিখ পরিবর্তন করা হচ্ছে।এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সমকালকে বলেন, অবরোধ-হরতালের কারণে আদালতে বিচার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হরতালে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা ভয়ে আদালতে আসতে পারেন না। তিনি বলেন, অবরোধে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ বসে। হরতালে হাইকোর্টের কয়েকটি বেঞ্চ বসলেও সব বেঞ্চ বসে না। হরতালে নিম্ন আদালতে মামলার সাক্ষী ও আসামিদের আদালতে হাজির করা যায় না। গত প্রায় এক মাসে দেশের সব আদালতে বিচার কাজ ঠিকভাবে না চলায় ভবিষ্যতে মামলাজট আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, সুশাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে ন্যায় বিচার ব্যবস্থা। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় ন্যায় বিচার তো দূরের কথা গোটা বিচার ব্যবস্থাকেই অনেকটা অচল করে তুলেছে। অথচ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মসূচিতে বিচার ব্যবস্থার কোনো দায় ছিল না। আন্দোলনের নামে সহিংসতার খেসারত দিতে হচ্ছে অসহায় বিচারপ্রার্থীদের।বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ সারাদেশের বিভিন্ন আদালতে সাড়ে ২৮ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.