ওবামার সফর থেকে কী পেল ভারত? by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

টানা ১০ বছর যে মানুষটি একটা দেশের চোখের বালি ছিলেন, রাতারাতি তিনি সেই দেশের নয়নের মণি হয়ে গেলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে না। নরেন্দ্র মোদি সেই দিক থেকে অনন্য। যে আমেরিকা তাঁকে ১০ বছর ভিসা দেয়নি, সেই আমেরিকা তাঁর পায়ের তলায় শুধু লালগালিচাই বিছিয়ে দেয়নি, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সেই দেশের প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বারের জন্য ভারত সফর করে গেলেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় রচনার কারিগর হয়ে থাকলেন! বারাক ওবামাকে ভারতে এনে একদা ব্রাত্য নরেন্দ্র মোদি সারা বিশ্বকে এই বার্তাই দিলেন যে রাজ্য ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি এখন আন্তর্জাতিক স্তরের নেতৃত্বের পাশে আসন পেতেছেন। সত্যি বলতে কি, ওবামার এই সফর কতটা চোখের তৃপ্তি ও কতটা প্রকৃত কাজের হবে, তা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই ছিল। বিশেষ করে মার্কিন মুলুকে। ভারতে আসার দুই দিন আগে ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে আসন্ন এই সফর নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ না করায় সেই সংশয় বেড়েও গিয়েছিল। কিন্তু তিন দিনের সফরের পর দেখা গেল, নাক-উঁচু মার্কিন সংবাদপত্রগুলোও এই ঘটনাকে উপেক্ষা করতে পারল না। বরং, তারা এই দুই রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত রসায়ন ও বহির্বিশ্বে তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কাগজ-কালি খরচ করতে শুরু করেছে। সফরের সার্থকতা এখানেই। এমন একটা সফরের পর লাভ-লোকসানের অঙ্ক কষা স্বাভাবিক নিয়মেই হয়ে থাকে। হচ্ছেও। প্রথম দিনেই দুই নেতা খুশি খুশি মনে পরমাণু চুক্তির জটিলতা কাটানোর কথা ঘোষণা করেন। ভারতের পরমাণু চুল্লি ও জ্বালানির ওপর চিরকালীন নজরদারির আবদার থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে আসে যেমন, ভারতও তেমন দুর্ঘটনাজনিত দায়বদ্ধতা থেকে মার্কিন সরবরাহ কোম্পানিদের সরাসরি আড়াল করার ফর্মুলা বের করে ফেলে বিমা কোম্পানিদের টেনে এনে। আপাতদৃষ্টিতে এই বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে এত দিনকার চুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব হলো মনে করা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এতটা সরল মনে করার কোনো কারণ নেই। মার্কিন কোম্পানিগুলো এই সমাধান সূত্রে কতটা সন্তুষ্ট তা অবশ্যই নির্ভর করবে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং পরমাণুবিরোধী লবি কতটা সক্রিয় হয় তার ওপর। পাশাপাশি, ভারতের বাজার মার্কিন পরমাণু শক্তি সরবরাহকারীদের কাছে কতটা লাভজনক তার ওপরও নির্ভর করবে তাদের আগ্রহ। এই বিষয়টি বাদ দিলে আমেরিকা এ দেশে অবকাঠামো নির্মাণে চার বিলিয়ন ডলার, অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের জন্য দুই বিলিয়ন ডলার এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে আরও দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। সাময়িক ভিসা নিয়ে যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে কাজের জন্য যাচ্ছেন, তাঁদের আরও সুবিধা দিতেও ওবামা প্রশাসন রাজি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির খুবই পছন্দের স্লোগান ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ সফল করার ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, বিনিয়োগের স্থান হিসেবে ভারত এখনো যথেষ্ট নড়বড়ে। এখনো এই দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওবামা এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা সামরিক ক্ষেত্রের সহযোগিতায় উৎফুল্ল। সারা পৃথিবীতে সমরাস্ত্র কেনার দৌড়ে ভারত এক নম্বরে। ঐতিহাসিক কারণেই এই বিপুল অস্ত্র বেচাকেনায় ভারতের অভিভাবক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার পতনের পর রাশিয়া। মোট আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশই ছিল তাদের। ইদানীং সেই আধিপত্যে থাবা বসাতে শুরু করেছে আমেরিকা। প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বিদেশি বিনিয়োগের হার ২৬ থেকে ৪৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান সফল করতে আমেরিকা কতটা এগোবে তার ওপর কিন্তু নির্ভর করবে আগামী দিনে ভারতের অস্ত্র বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের দখল কতটা ছড়াবে। প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার ক্ষেত্র অবশ্য বিশাল। ১০ বছর ধরেই এই ক্ষেত্রে ভারত ও আমেরিকা ক্রমেই কাছাকাছি আসছে। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রামসফেল্ড ও প্রণব মুখার্জি ১০ বছর আগে যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছিলেন, এই সফরে তা আরও ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এই চুক্তি, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যৌথ উৎপাদনের টোপ, পরমাণু চুক্তির বাস্তবায়নে দায়বদ্ধতার মীমাংসা এবং দুই নেতার যুগ্ম বিবৃতি চীনকে চঞ্চল করে তুলেছে। ওবামার সফর শেষ হওয়ার আগেই চীন তাই এই সফর নিয়ে যে মন্তব্য করেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে মোদি-ওবামার কাছাকাছি আসাটা তারা মোটেই পছন্দ করছে না। চীন বেশ বুঝতে পারছে, ভারত-আমেরিকা-জাপান অক্ষ এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের প্রভাব রুখতে সচেষ্ট। এনডিএ আমলে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজের বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘পাকিস্তান নয়, ভারতের আসল শত্রু চীন।’ জর্জ তাঁর এই বিশ্বাসের কথা কখনো গোপন করতেন না। পোখরান-২-এর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতেও সেই চীন প্রসঙ্গই বড় হয়ে এসেছিল। চিঠিতে তিনি বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে চীন-ভীতিকেই উল্লেখ করেছিলেন। হোয়াইট হাউস থেকে সেই চিঠি ফাঁস হয়েছিল। ভারত-চীনের সম্পর্কেও অতঃপর কিছুটা কাঠিন্য এসেছিল। এবারও মোদি-ওবামা বৈঠকের পর নিউইয়র্ক টাইমস খবর করে, দুই নেতার প্রথম বৈঠকের প্রথম পৌনে এক ঘণ্টা কেটেছিল শুধুই চীন নিয়ে। চীন নিয়ে ভারতের নানা উৎকণ্ঠা ও সংশয় ঝরেছিল মোদির কণ্ঠে। এর পরেই প্রচারিত যুগ্ম বিবৃতি। তাতে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের নিরাপত্তা রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চীন সাগর নিয়ে বেইজিংয়ের স্পর্শকাতরতা বরাবরের। এ জন্য ভারতকেও তারা সময়ে সময়ে নরমে-গরমে শাসন করতে চেয়েছে। যুগ্ম বিবৃতি এটুকু তাদের ভালোমতোই বুঝিয়েছে, এশিয়ায় তাদের আধিপত্য রুখতে আমেরিকা ব্যবহার করতে চাইছে ভারতকে। নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের ওপর চীনা প্রভাবে ভারতও সজাগ। সে কারণেই আমেরিকার সাহচর্য ভারতের কাছে স্বাগত। ঠান্ডাযুদ্ধের পর সম্পর্কের চিরায়ত ধারণাগুলোও বদলে বদলে যাচ্ছে। ওবামার বন্ধুতা ও মার্কিন সংস্রব ভারতের কাছে তাই দখিনা বাতাস। চীনও তা বুঝে সজাগ সাবধানবাণী শুনিয়ে বলেছে, ‘শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়েই বিবাদে যুক্ত দেশগুলো সরাসরি নিজেদের সমস্যার সমাধান করুক। বিবাদে যারা যুক্ত নয়, সেই দেশগুলোর উচিত জল ঘোলা না করে দূরে থাকা।’
চীনের প্রতিক্রিয়া তাদের দিক থেকে সংগত। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা পাকিস্তানকেও টেনে এনেছে। তাদের সিনকিয়াং প্রদেশে ইসলামি জঙ্গিয়ানা বৃদ্ধির পেছনে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলোর মদদের কথা জানা থাকা সত্ত্বেও বেইজিং বলেছে, পাকিস্তানই তাদের ‘সব ঋতুর বন্ধু এবং সেই স্থান অন্য কেউ পূরণ করতে পারবে না’। ওবামার এই সফর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল। সেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পাকিস্তানকে কাছে টেনে যুগ্ম বিবৃতির পাল্টা মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে চীন তার হতাশা ও মরিয়া অবস্থারই প্রমাণ রাখল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রতিক্রিয়া ভারতের প্রতি একটা বার্তা। সেই বার্তা বুঝে মোদিকেও কিন্তু একটা দুর্দান্ত ব্যালান্সের খেলা দেখাতে হবে। তাঁর কাছে এটাও ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বড় পরীক্ষা। এমন নয় যে ওবামা সফর শেষ করে গেলেন আর সফরের সুফল সঙ্গে সঙ্গে ফলতে লাগল। ভারতীয় বাজার মার্কিনদের কাছে লোভনীয় ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যেও এখনো নানা সংশয় রয়েছে। এখানে বাণিজ্য করতে গেলে কর আইনের সংশোধন কতটা হবে, কী কী সুবিধা কোন পরিমাণে মিলবে, পেটেন্টের বাধা কতটা বিপত্তির সৃষ্টি করবে—এসব চিন্তা ও প্রশ্ন তাদের রয়েছে। মোদি-ওবামার রসায়ন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যে জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই আগামী দিনগুলোতে দুই দেশকে এগোতে হবে। কিন্তু সেই অগ্রগতির জায়গায়ও মোক্ষম কথাটি একেবারে শেষবেলায় ওবামাই শুনিয়ে গেলেন। বহুত্ববাদী ভারতীয় সমাজ, ভারতীয় গণতন্ত্র, বৈচিত্র্যময় ঐক্য, ধর্মীয় সহনশীলতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতাই যে ভারতের এগিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার, সে কথা চমৎকারভাবে তিনি মনে করিয়ে দিলেন। বললেন, এই বাঁধন অটুট থাকলে ভারতের উত্থান কেউ ঠেকাতে পারবে না। এই ঠাসবুনোন নষ্ট হলে ভারতও ভেঙে যাবে। নয়াদিল্লির সিরি ফোর্ট প্রেক্ষাগৃহে সেদিন একজন রাজনীতিকও উপস্থিত ছিলেন না। অথচ ওবামার ওই বার্তা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। নিতান্ত এক চাওয়ালার ছেলে, যিনি বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের কর্ণধার, এই বার্তা ছিল তাঁর ও তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি, কর্তব্য ও বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্বে কক্ষচ্যুত না হওয়ার সাবধানবাণী।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.