বইমেলার ‘ইন্টারন্যাশনাল কর্নার’ by সৌমিত্র শেখর

আর মাত্র কয়েক দিন। পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে বাঙালির প্রাণের মেলা—অমর একুশের বইমেলা। ইতিমধ্যে বিশ্বের নানা প্রান্তে এই বইমেলার সংবাদ পৌঁছে গেছে। ২০১১ সালে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনকে অনুষ্ঠানে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন: ‘বইমেলা আর অমর্ত্য সেন আসবেন, তাই রক্তের টান বাদ দিয়ে প্রাণের টানে এসেছি।’ এই প্রাণের টান কেবল প্রধানমন্ত্রীর নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের। এবার এই আন্তর্জাতিকতার ব্যাপারে আর এক ধাপ অগ্রসরতার সংবাদ এসেছে এবং সেটা হলো: এবার বইমেলায় থাকছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। আটটি দেশের সাহিত্যিকেরা এই সম্মেলনে অংশ নেবেন। শুধু সংবাদের মাধ্যমে নয়, অমর একুশের বইমেলাকে প্রকৃতভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। আগে এটি বাংলা একাডেমির আঙিনায় ছিল, এখন সেটি বাইরে এসেছে। এতে লাভ হয়েছে সবার। বইমেলাকেও সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিকীকরণের ফলে লাভবান হবে সবাই। অমর একুশে বইমেলায় আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি এর আকর্ষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং তাঁদের মাধ্যমে এই বইমেলাকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জ্ঞানচর্চাকারীদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ ঘটে। অমর একুশের বইমেলাকে আমাদের অনেকেই শুধু বাংলা ও বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার পক্ষপাতী। তাঁরা মনে করেন, একুশে ফেব্রুয়ারি যেহেতু বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া হয়েছিল, সেহেতু এই দিন আর কারও নয়—শুধু বাংলা এবং বাঙালির। এ ধরনের চেতনা থেকে তাঁরা অমর একুশের বইমেলায় শুধু বাংলাদেশের প্রকাশকদের বই বিক্রির পক্ষে। তাঁদের এ চিন্তাকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন করেন আমাদের দেশের কতিপয় প্রকাশক। এই প্রস্তাব সমর্থন করার সময় আমাদের দেশের প্রকাশকেরা অতিমাত্রায় দেশপ্রেমের কথাও বলেন। প্রকাশকদের বক্তব্যকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এখন ভাবার সময় এসেছে, কী করে একুশের বইমেলাকে আন্তর্জাতিক করা যায়! কারণ, একুশে আজ আর শুধু বাঙালির নয়, সারা বিশ্বের। একুশে যে বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেল (১৯৯৮), উচিত ছিল সে বছর থেকেই একুশের বইমেলাকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দেওয়ার প্রক্রিয়াটি আরম্ভ করা। তা হয়নি। অমর্ত্য সেনকে অতিথি করে আনার মাধ্যমে তা আরম্ভ হয়েছে। এ বছর বইমেলায় আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের মাধ্যমে তা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। আশা করব, এখন থেকে বিশ্ববিখ্যাত অন্তত একজন ব্যক্তিত্বকে প্রতিবছর বইমেলায় অতিথি করে আনা হবে, সঙ্গে অতিথি হিসেবে থাকবেন একজন দেশি প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব। শুধু তাই নয়, বইমেলার একটি প্রান্তে বিদেশি বই বিক্রির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। মেলার বিভিন্ন অংশের নামকরণ হয় যেমন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শহীদুল্লাহ, রোকেয়া, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ বাঙালি মনীষীর নামে। এখানে থাকে শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গন। আবার লিটল ম্যাগাজিন বিক্রির স্থানও আলাদা। শেক্সপিয়ার, তলস্তয়, গ্যেটে প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বিদেশি মনীষীদের মধ্যে প্রতিবছর যেকোনো একজনের নামে একটি অঙ্গন নির্দিষ্ট করে সেখানে বইমেলার ‘ইন্টারন্যাশনাল কর্নার’ স্থাপন করা যায়। আমাদের বইমেলায় ইংরেজি বই যে বিক্রি হয় না, তা কিন্তু নয়। এ দেশের হাতে গোনা দু-একটি প্রকাশক কিছু ইংরেজি বই মেলায় বিক্রি করেন। অতএব মেলায় ইংরেজি বই বিক্রি হচ্ছেই। মেলায় ইংরেজি বই বিক্রি করা যাবে না—এমন বাধা যৌক্তিক নয়। মনে রাখতে হবে, এ দেশের বৌদ্ধিক বিকাশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক জ্ঞানরাজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অনেকে পঠন-পাঠনের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট প্রসঙ্গ তুলবেন। কিন্তু ভাবতে হবে, ইন্টারনেট কাগজের বইয়ের বিকল্প নয়। এ দেশে পাইরেট বই পাওয়া যায় বটে, তবে শুধু জনপ্রিয় বইগুলোই পাইরেসি করেন ব্যবসায়ীরা। আধুনিক জ্ঞানরাজ্যের সাম্প্রতিক ও প্রয়োজনীয় (হয়তো প্রচলিতভাবে সেগুলো অজনপ্রিয়ও) বই পেতে হলে তাই মূল প্রকাশকদের দ্বারস্থই হতে হবে। এ ধরনের বই পাঠ এবং অনুবাদ হলে এ দেশের লেখক ও পাঠককুল উভয়ই সমৃদ্ধ হবেন—জ্ঞানরাজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভালো বই না পড়লে ভালো বই লেখা যায় না—এ কথা স্বীকার করতে হবে। বইমেলার ‘ইন্টারন্যাশনাল কর্নার’ হলে সেখানে বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশকদের আগমন নিশ্চিত করাও জরুরি। শুধু দূতাবাসের সরকারি ‘নিউজ লেটার’ বিনা মূল্যে পাওয়ার জন্য বইমেলায় ‘ইন্টারন্যাশনাল কর্নার’ চাই না। বইমেলায় ‘ইন্টারন্যাশনাল কর্নার’ হতে হবে সত্যিকার অর্থেই বিদেশি সাম্প্রতিক ও দরকারি বইয়ের প্রাপ্তি ও সন্ধানস্থল। দেশি প্রকাশক ও বিক্রেতাদের ‘আবদার’ বিবেচনায় রেখে ‘ইন্টারন্যাশনাল কর্নার’-এ বিদেশে মুদ্রিত বাংলা বই বিক্রি রহিত করা যেতে পারে। কিন্তু ইংরেজি ও অন্য ভাষার বিদেশি বইয়ের ক্ষেত্রে একুশের বইমেলা উন্মুক্ত করার সময় এখনই।
ড. সৌমিত্র শেখর: নজরুল-অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
143soumitra@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.