প্রায় অচল সড়কপথ, ট্রেন ধুঁকছে সময়সূচি নিয়ে by আনোয়ার হোসেন

চলমান অবরোধ ও হরতালের কারণে মহাসড়কে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চলাচল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অন্তত ৬০ শতাংশ কমে গেছে। নাশকতা এড়াতে গতি কমানোয় ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়েছে এবং যাত্রী ও আয় কমে গেছে। এখন পর্যন্ত কেবল লঞ্চ চলাচলই স্বাভাবিক আছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূরপাল্লার যে ৪০ শতাংশ যানবাহন চলছে, সেগুলো কেবল কাছাকাছি দূরত্বে। আর নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ পাহারায় ৪০-৪৫ শতাংশ পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় সচল থাকা রেলওয়ের সময়সূচিও ভেঙে পড়েছে। আগে ৮০ ভাগ আন্তনগর ট্রেন সময় মেনে চললেও এখন মাত্র ৪০ শতাংশ সময় মেনে চলতে পারছে। রেলওয়ের হিসাবে, জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনের তুলনায় পরবর্তী ১০ দিনে শুধু রেলের ঢাকা বিভাগীয় এলাকার ২১টি স্টেশনে যাত্রী কমে যায় ১ লাখ ৪০ হাজার। আর আয় কমেছে ৪২ লাখ টাকা। সময়সূচি বিপর্যয়ের কারণে অন্তত ২৫টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হয়েছে। সাধারণত কোনো ট্রেনের যাত্রা ২৪ ঘণ্টা বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে যাত্রা বাতিল করা হয়। অবরোধে একমাত্র লঞ্চ চলাচলই স্বাভাবিক আছে। কিন্তু লঞ্চের কেবিনে যাত্রী সেজে উঠে আগুন দেওয়ার চারটি ঘটনার পর সেখানেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এখন কেবিনের যাত্রীদের দেহ তল্লাশি করা হয়। যাত্রীদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। লঞ্চমালিকেরা জানিয়েছেন, চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও লঞ্চে যাত্রী কমে যাচ্ছে। আতঙ্কের পাশাপাশি অবরোধ-হরতালের কারণে বিভিন্ন গন্তব্যে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে না পারা এর একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আবার সড়কপথের অনেক যাত্রীও যেখানে সম্ভব নৌপথ ব্যবহার করছেন।
সড়ক যোগাযোগ ৪০ ভাগ সচল: উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগের প্রধান পথ বঙ্গবন্ধু সেতু। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলাচল কমে গেছে ৫ হাজার ২১০টি। আয় কমেছে গড়ে ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকা। র্যাব ঢাকা-চট্টগ্রামসহ চারটি মহাসড়কের ২১৬টি স্থানকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর হাইওয়ে পুলিশ সারা দেশের ৯৯৩টি স্থানকে চিহ্নিত করেছে স্পর্শকাতর হিসেবে। গত বৃহস্পতিবার আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এই ৯৯৩টি স্থানে প্রায় ১২ হাজার আনসার মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে ২১৬টি স্থানে আনসার মোতায়েন করা হবে। টানা অবরোধে ঢাকা ও এর আশপাশের যোগাযোগ অনেকটাই স্বাভাবিক আছে। কিন্তু দূরপাল্লার যোগাযোগ প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগে স্থবিরতা নেমে আসছে। ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের টানা অবরোধ শুরু হলেও আগের দিন ৫ জানুয়ারিই সড়কপথে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। ৫ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যান চলাচল করেছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৭১৯টি। এ সময় দৈনিক গড়ে যান চলেছে ৭ হাজার ৩৯৬টি। অথচ ১ থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করেছে ১২ হাজার ৬০৬টি।
সেতু বিভাগের হিসাবে, ৫ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ২২ দিনে টোল আদায় হয়েছে ১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। দৈনিক গড়ে আয় ৫৮ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। আর ১ থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত টোল আদায় হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। গড়ে প্রতিদিন ১ কোটি ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ অবরোধের কারণে টোল আদায় ও যানবাহনের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। সূত্র জানায়, অবরোধের সময় যেসব যানবাহন চলেছে, এর বেশির ভাগই মালবাহী ট্রাক ও ব্যক্তিগত কার। যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা খুব কম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজাটি কম্পিউটারনিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় সেখানকার যানবাহন চলাচল ও আয়ের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরবঙ্গের পথে বিভিন্ন কোম্পানির দূরপাল্লার বাস প্রায় বন্ধ। কিছু লোকাল বাস চলাচল করে ঝুঁকি নিয়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের চৌদ্দগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেখানেও একই অবস্থা।
ধুঁকছে রেল: রেলের দৈনন্দিন সময়সূচি অনুসারে, ৬ থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আন্তনগর ট্রেনের মাত্র ৪৪ শতাংশ সময় মেনে চলতে পেরেছে। বাকি ট্রেনের বেশির ভাগই ৩ থেকে ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে চলেছে। গত ১ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ট্রেন সময় মেনে চলেছিল। ওই সময় কোনো ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হয়নি। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিটি আন্তনগর ট্রেনের সপ্তাহে এক দিন যাত্রাবিরতি আছে। মূলত যাত্রাবিরতির পরদিনই ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময় মেনে চলতে পারছে। রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাতিল হওয়া ২৫টি ট্রেনের যাত্রীদের বেশির ভাগই টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে গেছেন। কেউ কেউ পরের দিনের সময়সূচি অনুসারে যে ট্রেনটি চলেছে, সেটিতে চড়েছেন। ২৭ জানুয়ারি দিনাজপুরগামী দ্রুতযান ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশন থেকে নির্ধারিত সময়ের ১৬ ঘণ্টা পর ছেড়ে যায়। লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ট্রেনটি বুধবার ছেড়ে যায় ১৪ ঘণ্টা দেরিতে। রংপুর এক্সপ্রেস ৪ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট ও চট্টগ্রামের পথের মহানগর প্রভাতী ট্রেনটি চলেছে নির্ধারিত সময়ের সোয়া তিন ঘণ্টা দেরি করে। রেলের কর্মকর্তারা জানান, জানুয়ারি মাসে বরাবরই যাত্রী বেশি হয়। এবারও জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন যাত্রী এবং আয় ভালো ছিল। কিন্তু সময়সূচি বিপর্যয়ের কারণে পরবর্তী ১০ দিন যাত্রী কমতে থাকে। যাত্রী কমা ও আয় হ্রাসের ধারা এখনো অব্যাহত আছে। রেলের প্রতিটি বিভাগীয় বাণিজ্যিক কার্যালয় থেকে প্রধান কার্যালয়ে ১০ দিন অন্তর যাত্রী ও আয়ের হিসাব পাঠানো হয়। এ থেকে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অধীন কমলাপুর, বিমানবন্দর, জয়দেবপুর, সিলেটসহ গুরুত্বপূর্ণ ২১ স্টেশনের যাত্রী ও আয়ের হিসাব পাওয়া গেছে। তাতে দেখা গেছে, ১১ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই ২১ স্টেশন থেকে যাত্রী পরিবহন হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৯৩৫ জন। এ সময় আয় হয় প্রায় ছয় কোটি টাকা। অন্যদিকে ১ থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ২১ স্টেশন থেকে যাত্রী পরিবহন করেছিল ৫ লাখ ২৬ হাজার ৩৪৮ জন। এ সময় আয় হয় ৬ কোটি ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনের তুলনায় পরের ১০ দিনে যাত্রী কমে যায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার। আর আয় কমে প্রায় ৪২ লাখ টাকা। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চার দফা নাশকতা ও অবরোধে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের কারণে রেলের সময়সূচি বিপর্যয় হয়েছে। নাশকতার আশঙ্কায় সব ট্রেনের গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে ব্রডগেজ ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারিত আছে ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার। আর মিটারগেজে সর্বোচ্চ ৭২ কিলোমিটার। এ ছাড়া রাতের ট্রেনগুলো চালানোর আগে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে এক ইঞ্জিন ও এক বগির (পাইলট ট্রেন) একটি ট্রেন নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। এরপরই যাত্রীবাহী ট্রেন চালানো হয়। এতে ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে বাড়তি সময় অপেক্ষায় রাখতে হয়। রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তাকেই তাঁরা সর্বাধিক প্রাধান্য দিচ্ছেন। এ জন্য সময়সূচিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। যেকোনো মূল্যে ট্রেন চালু রাখাই মূল চিন্তা।

No comments

Powered by Blogger.