ভূরাজনীতি- ইউরোপের জিহাদি প্রজন্ম by হাভিয়ের সোলানা

উন্নততর জীবনের সন্ধানে সে আলজেরিয়া থেকে এসেছিল। প্রত্যাশা ছিল, দারিদ্র্য, নিপীড়ন ও নিরাশার জীবন থেকে মুক্তি মিলবে। প্যারিসে সে নিম্ন-দক্ষতার কাজ পায়, এরপর তার সন্তান হয়, সেই সন্তানেরও সন্তান হয়। ফরাসি নাগরিক হিসেবে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকার ছিল। কিন্তু তারা বেড়ে ওঠে ঘেটোতে, ফ্রান্সের বড় শহরগুলো ঘিরে আছে এসব ঘেটো। তাদের মতো অনেক পরিবারের বসবাস এসব ঘেটোয়। আক্ষরিকভাবেই, তাদের বসবাস সমাজের এক প্রান্তে। কিন্তু ফরাসি সমাজে পুরোপুরি মিশতে না পারায় তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ খুব বেশি মেলেনি। ফলে স্বর্গপ্রাপ্তি আর সম্ভব হয়নি। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই এ নাটকের অসংখ্য মঞ্চায়ন হয়েছে: দারিদ্র্যের মধ্যেই অভিবাসীদের জীবন পেরিয়ে যায়, সমাজেও তাদের স্থান হয় না বললেই চলে। সবচেয়ে খারাপ ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, চরমপন্থী দলগুলো তাদের দলে ভেড়ায়। প্রবাসীজীবনে যে জিনিসগুলোর অভাব সবচেয়ে বেশি তারা অনুভব করে, চরমপন্থী দলগুলো তাদের সেগুলোর সন্ধান দেয়: অঙ্গীভূত হওয়ার বোধ, পরিচয় ও উদ্দেশ্য। সারা জীবন প্রান্তিক থাকার পর বৃহত্তর উদ্দেশে্য অংশগ্রহণ, মিথ্যা, আত্মবিনাশ ও এমনকি মৃত্যুও সেই আকাঙ্ক্ষিত জীবনের না-পাওয়া অঙ্গীভবনের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। প্যারিসের ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি এবদোয় হামলা ও বেলজিয়ামে অন্য আরেকটি হামলার আশঙ্কা রুখে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের নিজের দিকে ভালোভাবে তাকানো দরকার। তাদের এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসীরা চরমপন্থীদের মিষ্টি কথায় ভুলে বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। কারণ, ইউরোপীয় নাগরিকত্ব পেলেও তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি। আর এই ক্রমবর্ধমান অসমতার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে চলা সংকটের কারণে তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। মানুষের দরকার আশা। তাঁদের স্বপ্ন দেখা দরকার, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা দরকার, যা তাঁদের উন্নততর জীবনের প্রতিশ্রুতি দেবে। ইউরোপের দেশগুলো একসময় সে আশার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এই সংকট ও তার প্রতি যে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে, তাতে আশার জায়গায় শুধু হতাশা ও মোহভঙ্গই দেখা যাচ্ছে। এর ফলে অভিবাসীবিরোধী জনপ্রিয় ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদী ধারার জন্ম হয়েছে, একইভাবে। হিসাব অনুসারে, সিরিয়ার জিহাদে ১ হাজার ২০০ জনের অধিক ফরাসি নাগরিক যোগ দিয়েছে। এর সঙ্গে আছে যুক্তরাজ্যের ৬৫০, জার্মানির সাড়ে ৫৫০ ও বেলজিয়ামের ৪০০ নাগরিক। স্পেনেও একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর শার্লি এবদোর ঘাতকদের মতো কিছু ইউরোপীয় নাগরিক ঘরের মধ্যেই এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছে।
হ্যাঁ, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী অবশ্যই আক্রমণ নস্যাৎ করবে, কিন্তু সন্ত্রাসী তৎপরতা রুখতে কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করতে হলে কী কারণে এই মানুষেরা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকছে, সেটা বুঝতে হবে। ইউরোপকে শুধু মতামতের স্বাধীনতা ও পুলিশি সুরক্ষা নিশ্চিত করলেই চলবে না। এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বের করতে হলে এই মানুষদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রান্তিকীকরণের বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যে নিতে হবে। আর সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব এড়াতে হবে, শুধু নিপীড়নের ওপর নির্ভরশীলতা এড়াতে হবে। আরেকটি মৌলিক কাজ করতে হবে। এমন প্রকৃতির সমাধানের জন্য স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার মধ্যকার মিথ্যা দ্বি-বিভাজন দূর করতে হবে। নিরাপত্তার ধুয়া তুলে যদি মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন² করা হয়, তাহলে গোঁড়ামির জয়জয়কার হবে। আবার ইসলাম ও বিদেশিদের সম্পর্কে যদি অহেতুক ভীতি ছড়ানো হয়, তাহলেও সেই একই ব্যাপার ঘটবে। প্যারিস হামলার এক সপ্তাহ পর জার্মানির চ্যান্সেলর অাঙ্গেলা ম্যার্কেল সাবেক জার্মান প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান ভুল্ফের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলুর পাশে দাঁড়িয়ে ম্যার্কেল ঘোষণা দেন, ইসলাম জার্মানির অংশ, ঠিক যেমন খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম তার অংশ। এর মধ্যেই সঠিক পথ নিহিত রয়েছে বলে আমি মনে করি। মুসলিম অভিবাসীদের অবশ্যই ইউরোপীয় সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। ইউরোপের অন্য অধিবাসীদের মতো একই সুযোগ তাদের পাওয়া উচিত; তা সে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসী হোক না কেন। বৈশ্বিক পর্যায়েও এ নীতি প্রয়োগ করা উচিত। অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো গঠন করতে হবে, যা মুসলিম দুনিয়ায় একসঙ্গে উন্নয়ন নিশ্চিত ও গোঁড়ামি দূর করবে। খ্রিষ্টীয় সমাজও আক্রমণাত্মক গোঁড়ামি ও অন্তর্কলহে বহুকাল পিছিয়ে ছিল, কিন্তু তা অনেক আগেই অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর তার অবস্থান সেখানেই হওয়া উচিত। ধর্ম শুধু বিশ্বাসের ব্যাপার নয়। এটা একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও ভাষা, এমনকি সে বাজারের খেলোয়াড়ও বটে, যে কিনা সমর্থকের জন্য প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। মুসলিম দুনিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে বিপ্লবী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের ‘প্রকৃত’ ইসলামের বিকৃত ধারণা আরও পোক্ত করতে চায়, মুসলমানদের জয় করতে চায়।
আজ আল-কায়েদার সঙ্গে যোগ দিয়ে আইএস ও বোকো হারাম সারা দুনিয়ার মুসলমানদের আকৃষ্ট করার সংগ্রামে নেমেছে। এর মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক জিহাদে নিজেদের নেতৃত্ব বজায় রাখতে চায়। এই গোষ্ঠীগুলো অবাধ্য পরিস্থিতি, দুর্বল ও ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানের সুযোগ নিয়ে নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আসলে সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে আরব বসন্তের পর কাঙ্ক্ষিত উত্তরণ না ঘটায় ইসলামি স্টেটের উত্থান ত্বরান্বিত হয়েছে। লাখো তরুণ উন্নততর কিছু প্রত্যাশা করার সাহস দেখিয়েছে, যদিও বছরের পর বছর ধরে সামাজিক পক্ষাঘাত, বেকারত্ব ও নির্মম একনায়কত্বে সেই সমাজগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন। তিউনিসিয়া কিছু উন্নতি করলেও অধিকাংশের অবস্থাই সঙিন। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে জিহাদ খণ্ডিত চরিত্রের। এই ধারার অন্যান্য কর্মসূচির মতো সেও বহু মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। যে গুণটা তাদের মধ্যে সব সময় দেখা যায়, তা হচ্ছে অন্তঃসারশূন্যতা ও উদ্দেশ্যহীনতা। পশ্চিমকে বুঝতে হবে, বিদেশিদের সামরিক হস্তক্ষেপে আরব দুনিয়ার সংঘাত নিরসন সম্ভব নয়। এ অঞ্চলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার একমাত্র উপায় হলো, মধ্যপন্থী মুসলমানদের ক্ষমতায়ন করা। যাতে তারা সহিংসতা ও আমূল সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে। পশ্চিমের কাজ হচ্ছে, সেটা চিহ্নিত করে তাদের গ্রহণ ও সমর্থন করা। দেশে ও দেশের বাইরে—সব ক্ষেত্রেই এই শিক্ষা প্রয়োগ করা উচিত।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
হাভিয়ের সোলানা: ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব।

No comments

Powered by Blogger.