দগ্ধ সাফিরের কান্নার শেষ কোথায়? by মানসুরা হোসাইন

(রাজধানীর সিটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন সাফির। ছবিটি আজ সকালে তোলা। ছবি: জাহিদুল করিম) আড়াই বছরের ছোট্ট শিশু সাফির। পেট্রলবোমায় দগ্ধ এইটুকুন শরীরে এখন যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু নেই। তার ছোট ছোট বায়না, দুদ্দাড় ছোটাছুটি, খিলখিল হাসি-সব বিলীন হয়েছে সর্বভুক আগুনের তাপে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সারাক্ষণ সে কাঁদছে, আর ছটফট করছে সীমাহীন যন্ত্রণায়। এই দহন-পীড়নে তার একটাই আকুতি-যন্ত্রণা থেকে কখন মিলবে মুক্তি?  সাফিরকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বোলানো যায় না স্নেহের পরশ। দুটো সান্ত্বনা কথা যাঁরা বলবেন, সেই বাবা-মাও আহত। এ অবস্থায়ই তাঁরা বারবার ছুটে যাচ্ছেন সোনামণির কাছে। চাঁদমামার ছেলেভোলানো ছড়া বা পছন্দের প্রজাপতির গল্প শুনিয়ে খানিকটা শান্ত করতে চাইছেন অতি আদরের খোকাকে। কিন্তু এ অভিনয় করতে গিয়ে তাঁরা নিজেরাই বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন, ভেঙে পড়ছেন কান্নায়। নিজেরা চিকিৎসক হয়েও দগ্ধ সন্তানের এ পরিস্থিতির কাছে তাঁরা অসহায়। আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর লালমাটিয়ায় সিটি হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। চিকিৎসক দম্পতি সাইফুল ইসলাম ও শারমিন সিদ্দিকা সেখানে সাফিরের কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন। গত রোববার রাত সাড়ে নয়টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়েছে সাফির। তার শরীরের ১৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। ছেলের শরীরের আগুন নেভাতে গেলে সাইফুল ইসলামের হাত পুড়েছে ৫ শতাংশ। হাতের হাড়েও চিড় ধরেছে। শারমিন সিদ্দিকার কপালে জখম হয়েছে। কপালের খানিকটা ও চোখের কোণ পুড়েছে। একটা হাতও ভেঙেছে। রোববার রাতেই এই পরিবারের তিনজন সিটি হাসপাতালে ভর্তি হন। এখন পুরো পরিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সাফির বারবার মা ও বাবাকে ধরতে চাইছে। কিন্তু দুই হাতে ব্যান্ডেজ থাকায় পারছে না। একই সঙ্গে সাফিরের মায়ের ডান হাত বাঁধা। বাবার বাঁধা বাঁ হাত। ডান হাতেও ব্যান্ডেজ। তাঁরাই বা ছেলেকে কীভাবে ধরবেন? কীভাবে আদর করবেন?
সাফির একটানা কান্নার পর একটু ঘুমিয়ে যায়, খানিক পর চমকে পাশ ফেরে। দেখে নেয় বাবা-মা আছে কি না। আবার শুরু হয় কান্না। শারমিনের ভাষ্য, ভর্তি হওয়ার পর আজই তিনি ছেলেকে প্রথম দেখার সুযোগ পেয়েছেন। মাত্র চার মাস বয়সী আরেক ছেলে এখন আছে নারায়ণগঞ্জে শারমিনের মায়ের কাছে।
১৫ দিন আগেই সাফিরের পা গরম পানিতে পুড়ে যায়। সেই পা আবার দগ্ধ হয়েছে। এখন দুই হাত, পুরো মুখ, এক পা-সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ছেলের অবস্থা দেখে যখন বাবা-মা বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ, তুমি ছেলেকে ভালো করে দাও।’
শারমিন সিদ্দিকা কথা বলার শুরুতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি বলেন, কথা বলে কী হবে? অজানা উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা এসব বন্ধ করুন।’ তিনি জানান, রোববার সাফিরের পোড়া পায়ের শেষ ড্রেসিং ছিল। পায়ের পোড়া জায়গা দেখে সে যাতে ভয় না পায়, এ জন্য মোটা মোজা দিয়ে তাকে জুতা পরিয়ে রাখার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। এই জুতা-মোজা কিনেই তাঁরা ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে মায়ের কাছে যাচ্ছিলেন। শারমিন সিদ্দিকা বলেন, ‘নতুন কেডস আমার ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে। কেনার পর সে কী খুশি! ও মাত্র কথা গুছিয়ে বলা শুরু করেছে। খুব দুরন্ত ছেলে আমার। আমরা বাসে উঠলাম। তারপর...’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা শুধু আমার বাচ্চা না, সব বাচ্চার কষ্টের কথা লেখেন। ওদের কষ্ট সবাই দেখুক।’ সিটি হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিফ কনসালট্যান্ট মো. শহিদুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, সাফির যে আশঙ্কামুক্ত, তা বলা যাবে না। তবে অবস্থা স্থিতিশীল আছে। ঘটনার পরপরই দ্রুত ঢাকায় চলে আসার ফলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়েছে। এখন পর্যন্ত লাইফ সাপোর্ট লাগেনি। যে পা আগে পুড়েছিল, সেই পা আবার পুড়েছে। সেই পায়ে অস্ত্রোপচার লাগতে পারে।
শহিদুল বারী বলেন, ‘চিকিৎসক দম্পতির কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি, সেই অনুযায়ী ঘটনার সময় সাইফুল জানালা দিয়ে স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন। এতে তিনি আগুন থেকে বেঁচে যান। তবে হাত ভেঙে যায়। অন্যদিকে সাইফুল বাচ্চা নিয়ে বের হতে গেলে হাত থেকে পিছলে পড়ে যায় ছেলে। ততক্ষণে ছেলের শরীরে আগুন ধরে যায়। সেই আগুন নেভাতে গেলে সাইফুলের হাতও পুড়ে যায়।’
সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক পোড়া পুড়ছি, আর পুড়তে চাই না। যেটাই করেন, এসব বন্ধ করেন। আমরা একটু বাঁচতে চাই। সরকার কী আমার ছেলেসহ যারা অবরোধের আগুনে পুড়ছে, তাদের সবার চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে?’ আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঘটনার পর বাস মালিক অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে একটি মামলা করেছেন। তবে এ ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.