দগ্ধ সাফির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে -ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ২৩ দিনে ২৮ জন ভর্তি

(চিকিৎসক দম্পতি সাইফুল ইসলাম ও শারমিন আহমেদের সঙ্গে ছেলে সাফির l পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া ছবি) সপ্তাহ দুয়েক আগে গরম পানিতে পা পুড়ে গিয়েছিল চিকিৎসক দম্পতি সাইফুল ইসলাম ও শারমিন আহমেদের আড়াই বছরের ছেলে সাফিরের। বার্ন ইউনিট থেকে চিকিৎসা নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফেরার পথে আবার অবরোধের আগুনে পুড়তে হলো ছোট্ট এই শিশুটিকে। গতকাল সোমবার সাফিরকে নেওয়া হয়েছে একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। হাসপাতালটির চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সাফিরের মাথা, গলা, ডান হাত, দুই পা পুড়ে গেছে। তার শরীরের ১৭ শতাংশই পোড়া। সাফিরের মামা মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছেন। বাবা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় শারমিন প্রায়ই নারায়ণগঞ্জে বাবার বাসায় থাকেন। এ ছাড়া সাফিরের একটি ভাই হয়েছে সম্প্রতি। গতকাল (সোমবার) মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে শারমিনের আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে কাজে ফেরার কথা। তাই রোববার স্বামী সাইফুল ইসলামসহ সাফিরকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে থেকে নারায়ণগঞ্জের বাসে উঠেছিলেন। রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাসে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা।
শারমিনের স্বজনেরা জানান, বাসে পেট্রলবোমা ছোড়া হয়েছে বুঝতে পেরে প্রথমেই সাইফুল ইসলাম স্ত্রীকে জানালা দিয়ে ঠেলে বাইরে বের করে দেন। পড়ে গিয়ে তাঁর হাত ভেঙে যায়। পরে সাইফুল সাফিরকে নিয়ে নেমে আসেন। ততক্ষণে সাফিরের গায়ে আগুন ধরে গেছে। সাইফুল বাস থেকে নেমে হাত দিয়ে সন্তানের শরীরের আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। এতে তাঁর নিজেরও দুই হাত পুড়ে যায়।
শারমিনের মামা ফারুক হোসেন খান বলেন, মায়ের হাত ভাঙা, বাবার দুই হাত পোড়া। সন্তানকে তাঁরা একটু ছুঁয়েও দেখতে পারছেন না। শারমিন সারা দিন শুধু কাঁদছেন।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে এখন ভর্তি ১৭:
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধে আগুন ও পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে মোট ২৮ জন ভর্তি হন। এদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ছিলেন ১৭ জন। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন দগ্ধদের মধ্যে চারজন নারী ও একজন শিশু রয়েছে। পাবনার আবু তাহেরের (৭০) শ্বাসতন্ত্রসহ শরীরের ১৪ শতাংশ পুড়েছে। তাঁকে রাখা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে।
আবু তাহেরের বড় ছেলে রতন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা অসুস্থ ছিলেন। দুই ভাই মা-বাবাকে আনতে পাবনায় গিয়েছিল। গাবতলী থেকে আসার পথে বাসের মধ্যে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এটি বাবার মুখে গিয়ে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে এক ভাইয়ের একটি পাও ভেঙেছে। আরেক ভাইয়ের হাত পুড়েছে। আমাদের পুরো পরিবার শেষ।’
এ ছাড়া নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রয়েছেন রাজশাহীর পুঠিয়ার ট্রাকচালক সিদ্দিক, বিল্লাল ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কনস্টেবল মোরশেদ আলম। এই তিনজনেরও শ্বাসতন্ত্র পুড়ে গেছে।
মাসুমের (১৫) বাড়ি নরসিংদীতে। তার শ্বাসতন্ত্রসহ শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। দরিদ্র পরিবারের ছেলে সে। ১৩ বছর বয়স থেকে বাসের চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে। সকাল সাতটায় বেরোয়, ফেরে রাত ১০টায়। ১৪ জানুয়ারি শহরের পল্লী বিদ্যুতের কার্যালয়ের কাছে রাত পৌনে ১০টায় বাসে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা।
মাসুমের বাবা আলেকচান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই। সংসার চালাতে পারি না। মাসুমকে পড়াতেও পারি নাই। তবে ওর রোজগারে ছোট তিন বোন পড়ালেখা করে।’
গত রোববার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে দগ্ধ ইডেন কলেজের দুই ছাত্রী শারমীন আক্তার ও জয়নাব আক্তারকে ছেড়ে দিয়েছে বার্ন ইউনিট। তবে দুজনকেই নিয়মিত হাসপাতালে এসে সেবা নিতে হবে।
নিন্দা, ক্ষোভ: চিকিৎসক দম্পতি ও তাঁদের সন্তানের ওপর হামলায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান ও মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলান। গতকাল এঁদের দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক জুলফিকার আলী ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক।
ইডেনের দুই ছাত্রী দগ্ধ হওয়ার ঘটনায় গতকাল কলেজের সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে ছাত্রীরা। তারা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে সরকারকে। তারা আগুনে পুড়িয়ে মারার রাজনীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ারও দাবি জানায়।

No comments

Powered by Blogger.