গুপ্তধনের সন্ধানে by সাদেকুল ইসলাম

গুপ্তধনের আশায় গ্রামবাসী দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও কেউ থামছেন না। এভাবে একটি বাড়ির ভিটে কেটে তছনছ করে দিচ্ছে মানুষ। নওগাঁর পোরশা উপজেলা সদরের পশ্চিম রঘুনাথপুর গ্রামের টেকটা নামক একটি বাড়িতে এ ঘটনা ঘটছে। মানুষ গুপ্তধনের আশায় এমনটি করছেন। দু’বছর ধরে চলছে এ কাণ্ড। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি জানে। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সম্পদশালী হওয়ার আশায় পুনর্ভবা নদীর পাশে টেকটা ভিটাকে ঘিরে প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় চলছে মাটি ওলট-পালটের খেলা। স্থানীয়রা জানান, দুই বছর আগে এক লোক টেকটা নামক ভিটা এলাকায় মাটি কাটতে গিয়ে কিছু মূল্যবান সম্পদ পান। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় কয়েক শ’ লোকের মাটি খনন। সেই থেকে প্রতিদিন সকাল হলেই স্থানীয়রা যে যার মতো কোদাল, খুনতি, শাবল দিয়ে মাটি খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রায় চার থেকে পাঁচ ফিট মাটি খুঁড়লেই মিলছে মূল্যবান জিনিস। মাটি খনন করলেই পাওয়া যাচ্ছে ছোট বড় অনেক রকমের পাথরসহ মূল্যবান সম্পদ। পাওয়া যাচ্ছে স্বর্ণালঙ্কার, চেইন, পয়সা, তাবিজ, তসবি, পাথর, রুপার কলম, ছোট বল আকারের বস্তু ইত্যাদি। এগুলোর একেকটির রঙ একেক রকম। কোনটা লাল, কাল, সাদা, কমলা, সবুজ আবার কতগুলো গোলাপি রঙের। স্বর্ণালঙ্কার পেলে সেগুলো বিক্রি না করে নিজের কাছে রেখে দেয়া হয়। তবে ছোট কিংবা বড় কোন পাথর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দেয়া হয়। ক্রেতারা সেখানে উপস্থিত থাকেন সর্বদাই। একেকটি পাথর আনুমানিক ১০ গ্রাম হলে তার মূল্য প্রায় ১৫ হাজার টাকা। স্থানীয়রা বলছেন, সম্পদের গুণগত মান অনুযায়ী এসব বস্তু বিশ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয় আমির উদ্দিন বাবু জানান, ওই গ্রামটিতে প্রায় ৫০ বছর আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতো। সেখানে একটি বড় কালীমন্দির ছিল। মন্দিরে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করা হতো। হয়ত ওই মন্দিরকে ঘিরে এখানে হাট-বাজার বসত। দেশ বিভাগের সময় হিন্দুরা ভারতে চলে যায়। তারা হয়ত তাদের মূল্যবান অনেক জিনিস নিয়ে যেতে পারেনি। পরে তাদের ঘরবাড়ি এবং মন্দিরগুলো ভেঙে মূল্যবান জিনিসগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। এলাকাবাসী মো. হুমায়ূন রেজা জানান, প্রায় ৬৫০ বছর আগের সম্রাট শের শাহর আমলে পুরো ভারত বর্ষ ৪৭টি পরগনায় বিভক্ত ছিল। তার মধ্যে একটি পরগনা হলো পোরশার পাশের থানা গোমস্তাপুরের রোকনপুর। পরে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে সুজাউদ্দীন (সুজার) আমলে সুদূর রাজমহল থেকে রোকনপুর পর্যন্ত সামুদ্রিক এলাকা ছিল। তখন বাংলার সুবেদার ছিলেন সুজা। সে সময় নৌকা বা জাহাজযোগে বহু মালামাল এখানে আমদানি ও রপ্তানি হতো। হয়ত কোন দুর্ঘটনায় সম্রাটদের সম্পদগুলো এ মন্দিরের পাশে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। যে নদীর পাশের এলাকা থেকে পাথর উঠছে ঠিক সেই জায়গায় হিন্দুদের কালীমন্দির ছিল। যার প্রমাণস্বরূপ কালীদহ বলে একটি কূপ আজও বিদ্যমান আছে নদীতে। সেখানে তারা পূর্জা শেষে ‘কালী-মায়ের’ মূর্তি বিসর্জন দিতেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের ধন-রত্নসহ মূল্যবান বস্তু মন্দিরে গচ্ছিত রাখতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় এখানকার অনেক জমিদার এবং সম্পদশালী বড় বড় হিন্দুরা সবাই ভারতে চলে যান। সর্বোপরি বলা যায় এ এলাকা ছিল ছিল বড় বড় হিন্দু ও রাজাদের আশ্রয়স্থল। কাজেই বহু মূল্যবান ধনরত্ন মাটির নিচে পড়ে থাকা অসম্ভব কিছু নয়। পাশের গ্রাম বিষ্ণপুর থেকে আসা মনিরুল ইসলাম জানান, তিনদিন ধরে তিনি থেকে মাটি খুঁড়ছেন। সেখানে একটি জালিবল পেয়েছেন। তা বিক্রি করেছেন ছয় হাজার টাকায়। নিতপুর থেকে আসা রুস্তম আলী চকচকে কাচের টুকরোর মতো একটা বস্তু পেয়েছেন। তা তিনশ’ টাকা দাম বলেছে। এছাড়া জহুরুল ইসলাম দুটি বোতাম ও একটি মার্বেল পেয়েছেন, যা পাঁচশ’ টাকায় বিক্রি করেছেন। স্থানীয় নজরুল ইসলাম জানান, একটি জালি পোটল ও একটি ফুটবল ৫৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। মো. তোফায়েল নামে এক যুবক জানান, সাতদিন খননের পর একটি গোলাপি বল পেয়েছেন। সেখানে থাকা পাচারকারীরা তা দেড়শ’ টাকা দাম বলছেন। দাম মনমতো না হওয়ায় সেটা বিক্রি করেননি। পাচারকারী মো. সাদু জানান, পয়সা, তাবিজ, তসবি, পাথর, রুপার কলম, ছোট বল, বড় ধরনের বল, আকার, রঙ (লাল, কাল, সাদা, কমলা, সবুজ) অনুযায়ী একেকটির গুণগত মান অনুযায়ী দাম দিয়ে কিনে নেয় হয়। এরপর সংবাদ দিলে বাইরে থেকে বড় বড় লোক এসে সেগুলো তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যান। তবে পাথরসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ উত্তোলনকারীরা বিক্রি করলেও স্বর্ণালঙ্কার কেউ বিক্রি করেন না। এলাকাবাসী রইচ উদ্দিন জানান, দুই বছর থেকে শত শত সাধারণ মানুষ মাটি খনন করে মূল্যবান সম্পদগুলো তুলে নিয়ে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি আরও মূল্যবান সম্পদগুলো উত্তোলন বন্ধ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। সরকারি উদ্যোগে সেখানে খনন করলে মূল্যবান কিছু বেরিয়ে আসবে। পোরশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার উদ্দিন শামীম জানান, এ বিষয়টা আমার জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.