অবৈধ বাজার বসিয়ে চাঁদাবাজি by অরূপ রায়

(সাভারের হেমায়েতপুরে ফুটপা​ত ও মহাসড়কে বসানো হয়েছে অবৈধ বাজার। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো) ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুর থেকে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন বসছে অবৈধ বাজার। সড়ক ও জনপথের (সওজ) জায়গায় বসানো এসব বাজারে রয়েছে প্রায় আট হাজার ভাসমান দোকান। ওই সব দোকান থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চাঁদা হিসেবে প্রতিদিন আদায় করছেন অন্তত ১৫ লাখ টাকা। এই চাঁদার ভাগ যাচ্ছে সরকারদলীয় নেতা আর পুলিশের পকেটে। আর যাত্রী ও পথচারীরা শিকার হচ্ছেন ভোগান্তির। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সহসভাপতি আশরাফ উদ্দিন খান গত শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী বাজার বসিয়ে এ চাঁদাবাজি করছে। এদের মধ্যে স্থানীয় সাংসদের আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন।’
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বছর অন্তত ১০ বার পরিদর্শন করে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। পরে নামকাওয়াস্তে উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হয়। সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী অবস্থান পাল্টে ফেলেন। অভিযান পরিচালনাকারী সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সওজ কর্তৃপক্ষকে মন্ত্রী তিরস্কার করেন। এর পরই হাল ছেড়ে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। আর এই সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন হকাররা (বিভিন্ন পণ্যের খুচরা বিক্রেতা)। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে সাভারের হেমায়েতপুর, গেন্ডা ও সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ভাসমান দোকানের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গেন্ডা বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীছাউনিতেও দোকান বসানো হয়েছে। সাভার বাসস্ট্যান্ড, হেমায়েতপুর, উলাইল ও গেন্ডায় অবৈধ দোকান সম্প্রসারিত হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলে এসেছে। হেমায়েতপুরে বিশৃঙ্খলা: ঢাকার গাবতলী আর সাভার পৌর এলাকার মাঝামাঝি স্থানে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ড। এখানে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ও ঢাকার কেরানীগঞ্জের সড়ক মিশেছে মহাসড়কে। কিন্তু মহাসড়কের ওপর ও মহাসড়ক ঘেঁষে সওজের জমিতে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় হাজার ভাসমান দোকান। দোকানিরা জানান, আকার আর ব্যবসার ধরনভেদে প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এখানে এসে থামলে চাঁদা দিতে হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ ভ্যান, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ইজিবাইক চালকদেরও। ব্যবসায়ী ও যানবাহন শ্রমিকদের কয়েকজন জানান, এসব চাঁদা তোলেন মুকুর, বাচ্চু, সানোয়ার, মোবারকসহ কয়েকজন তরুণ। বাচ্চু বলেন, ‘আমরা তো ভাই বেতনে কাজ করি। টাকা তো নিয়া যায় ট্রাফিক পুলিশ আর নেতারা।’ নেতাদের নাম জানতে চাইলে মুকুর বলেন, ‘আমরা ছোট কর্মচারী। এইসব জিজ্ঞাসা কইরা বিপদে ফালাইয়েন না ভাই।’
গেন্ডায় যাত্রীছাউনি দখল: সাভার উপজেলা পরিষদের মূল ফটকের বিপরীতে গেন্ডা বাসস্ট্যান্ড যাত্রীছাউনি। অবৈধ দোকান বসিয়ে এটি দখল করে ফেলা হয়েছে। শুধু ছাউনি নয়, মহাসড়ক ও এর পাশের খালি জায়গাও ফাঁকা নেই। এখানে দেড় শতাধিক দোকান বসিয়ে যাত্রী ও যান চলাচল সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। দোকানদারেরা জানান, দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন সাভার পৌর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম। চাঁদার হার দোকানভেদে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। জানতে চাইলে আমিনুল বলেন, ‘জায়গা ফাঁকা থাকায় সওজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কিছু দোকানপাট তোলা হয়েছে। ওই সব দোকানপাটের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমার লোকজন কিছু চাঁদা আদায় করে থাকে।’
সাভার বাসস্ট্যা‌ন্ডে হাঁটা যায় না: বাজার বসানোর কোনো জায়গা না থাকলেও ‘বাসস্ট্যান্ড কাঁচাবাজার’ নামে ইজারা দিয়েছে সাভার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। পুরো বাজারটিই গড়ে উঠেছে ফুটপাত ও মহাসড়ক দখল করে। সাভারের আড়াপাড়ার আতিকুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বাংলা ১৪২১ সনের জন্য ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কাঁচাবাজার ইজারা নেন। পরে ইজারার শর্ত ভেঙে সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে উপ (সাব) ইজারা দেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ফুটপাতসহ মহাসড়ক ও সড়কসংলগ্ন সওজের জমিতে ইচ্ছেমতো বাজার বসিয়ে ইজারার নামে চাঁদা আদায় করছেন। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মহাসড়কের উভয় পাশে সবজি, মসলা, মাছ, মাংস, ফলসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রায় ছয় হাজার ভাসমান দোকান বসানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, বেশ কয়েকজন তরুণ প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করেন। তাঁরা হকার্স লীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মী বলে পরিচয় দেন। সোহেল নামে এক ব্যক্তি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চাঁদা আদায় করেন। জানতে চাইলে সোহেল বলেন, এক আপার হয়ে তিনি চাঁদা নেন। ওই আপাই সিটি সেন্টারের সামনে পদচারী সেতুর আশপাশে অর্ধশত দোকান বসিয়েছেন। তবে কে সেই আপা, তা তিনি বলতে রাজি হননি।
কর্মকর্তারা যা বলেন: পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির ভাগ নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে সাভার থানার ওসি মো. আবদুল মোতালেব মিয়া বলেন, ‘আমি এ থানায় সম্প্রতি যোগ দিয়েছি। এ রকম অভিযোগ আমিও পেয়েছি। খতিয়ে দেখব। নানা কারণে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা সম্ভব না হলেও জনসাধারণের হাঁটাচলায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সে ব্যবস্থা করা হবে।’
সওজের কল্যাণপুর উপবিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সামসুজ্জোহা বলেন, কয়েক মাস আগে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এ জন্য ব্যবাসয়ীরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ওই ঘটনায় সওজের এক কর্মকর্তাকেই বদলি হতে হয়েছে। এ কারণে এসব অবৈধ বাজার উচ্ছেদে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নানা ঝামেলার মধ্যেও অবৈধ বাজার উচ্ছেদে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল সোমবার রাতে স্থানীয় সাংসদ এনামুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে ইউএনও ও ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.