পুব থেকে একটি রুগ্ন বাতাস বইছে by উইলিয়াম মাইলাম

শাসক আওয়ামী লীগ দ্বারা বাংলাদেশে নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর গত তিন সপ্তাহ ধরে বৃদ্ধি পেলেও মনে হচ্ছে সেটা যেন পরিস্থিতির বিরাট কোন অবনতি ঘটেছে ঠাহর করার জন্য যথেষ্ট নয়। বিরোধীদলীয় সদস্যদের খুবই অস্পষ্ট এবং মাঝে-মধ্যে সৃজনশীল অভিযোগে গ্রেপ্তার করা বা গ্রেপ্তারের হুমকি প্রদান করা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই লেখা পর্যন্ত গত ৯ দিনের বেশি সময় ধরে তাঁর কার্যালয়ে (এমনকি তাঁকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না) অবরুদ্ধ রয়েছেন। এটা তাঁকে এক ধরনের গৃহবন্দি করে রাখা। অন্যান্য বিরোধী দলসহ অন্য আর যারাই বাংলাদেশের ইতিহাস এবং চলমান ঘটনাবলীর সরকারি ভাষ্য গ্রহণ করছেন না, তাদের বিরুদ্ধেও হুমকি বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সরকারি লাইনে চলতে মিডিয়াকে ক্রমবর্ধমান  চাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, যারা অর্থের বিনিময়ে তাদের অবস্থান বদল করে থাকেন। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীসহ  বিএনপি’র অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অব্যাহতভাবে  গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মি. চৌধুরীর গ্রেপ্তার বিশেষ করে তাঁর অনেক মার্কিন এবং পাশ্চাত্যের দেশসমূহে থাকা বন্ধুদের জন্য উদ্বেগ বয়ে এনেছে। আওয়ামী লীগের কিংবদন্তি দলটি নিজেকে স্বাধীনতার অভিভাবক মনে করে। তাই এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, তারা মি. চৌধুরী, যিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১ সালের পৃথক হওয়ার যুদ্ধে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁকে রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মি. চৌধুরীর চেয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কেউ নেই, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জেলে পাঠানো হয়েছে, তার তালিকা দীর্ঘ। সেই তালিকায় মি. চৌধুরীর নামটি কেবল সর্বশেষে যুক্ত হয়েছে মাত্র। আর বিএনপি’র যারা গ্রেপ্তার এড়িয়েছেন, তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। দি ইকোনমিস্ট হলো পাশ্চাত্যের একমাত্র সাময়িকী, যেটি বাংলাদেশের রাজনীতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, তার মতে একজন টিভি চ্যানেল মালিককে পর্নোগ্রাফির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারণ ওই টিভি চ্যানেলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার করেছিল। লন্ডনে নির্বাসিত মিসেস জিয়ার পুত্র তারেক রহমান আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এটা আওয়ামী লীগের চোখে অবশ্যই একটি বেশ গর্হিত কাজ।
আওয়ামী লীগ সরকার ৫ই জানুয়ারিকে গত বছর একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বার্ষিকীতে দূরপাল্লার বাস সার্ভিস স্থগিত করেছিল। এটা অনুমেয় যে, যাতে গ্রাম এলাকার মানুষ সমাবেশে অংশ নিতে না পারে। যদিও আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যদি তারা ভাবতেন যে, জনগণ সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতেই আসছে, তাহলে আরও বেশিসংখ্যক বাসের দরকার পড়তো। অবশ্যই সেটা তারা ভাবেনি। এই সময়ে সরকারই সাধারণ মানুষের জীবন কঠিন করে তুললো।
শিগগিরই কিংবা বিলম্বে হলেও বাংলাদেশে সহিংসতা হবে।
সবধরনের বিরোধিতার বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা তীব্র করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ (প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে আজকের  দিনে কারো কাছেই জবাব দিতে হয় না বলে প্রতীয়মান হয়) তাদের একটি সিদ্ধান্তের প্রতি সঙ্কেত পাঠাতে পারেন যে, আওয়ামী লীগের একদলীয় সরকারকে সংহত করে একদলীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। এটা তারা যেন করতে চাইছে জনগণ তাদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় রুষ্ট হয়ে জনপ্রিয় গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সেটাই সম্ভবত নিপীড়নের চক্রকে তীব্রতা দিচ্ছে। বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে সহিংসতা এবং  উস্কে দিচ্ছে আরও অনেক বেশি অস্থিতিশীলতা।
এই নিবন্ধ ছাপা হওয়ার আগেই সহিংসতা শুরু হয়ে যেতে পারে। সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিএনপি একটি সমাবেশ করতে চায়। সরকার সম্প্রতি যদিও রাজপথের আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন এটা ধরে রাখতে যদি তারা চাপ সৃষ্টি করে চলে তাহলে সেটা হবে সহিংসতার রেসিপি।
স্পষ্টতই, যে কোন স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন কোন রাজনৈতিক দলের প্রধান এজেন্ডাই থাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। আর সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তারা যে কোন বিরোধী দল, যারা বৈধতা দাবি করতে পারে, তাদেরকে ধ্বংস করতে চায়। বিএনপি যদিও ক্ষমতায় থাকতে খারাপ রেকর্ড করেছে, কিন্তু তারা বৈধতা দাবি করতে পারে। উভয় দল খুবই খারাপভাবে শাসিত হয়েছে। বেশ কয়েক মাস ধরে এই গুজব চালু রয়েছে যে, কোন  না কোন অভিযোগে মিসেস জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হবে। সেটা সম্ভবত দুর্নীতি, কিংবা সম্ভবত ইকোনমিস্টের ভাষ্যমতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। আদালতসমূহের ওপর সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তাদের স্বৈরতান্ত্রিক মনমানসিকতা যা স্পষ্ট, তাতে আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের বিরোধী ভূমিকায় থাকা বিরোধীদলীয় নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনতে উৎসাহিত হতে পারে এবং আদালত তা সমুন্নত রাখবে। একটা বিস্ময় অবশ্য এই হতে পারে যে, দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষ দানা বাঁধার আশঙ্কা করে সরকার সকল বিরোধী দলের ওপর আগাম আঘাত হানতেই এই আকস্মিক দমন-পীড়ন শুরু করেছে।
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত জনরোষ এড়াতে পেরেছে কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে থেকেছে। দারিদ্র্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে, যদিও তা মন্থর গতিতে অগ্রসর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মিডিয়ায় নারীর ক্ষমতায়ন এবং অনগ্রসর শ্রেণীর ভাগ্য উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। কেউ হয়তো এই উপসংহার টানতে পারেন যে, পরিসংখ্যান ভিন্নচিত্র নির্দেশ করলেও সরকারের অবস্থা বাস্তবে যেরূপ, তার চেয়ে তাকে আরও বেশি ভালভাবে চিত্রিত করা সম্ভব হয়েছে। অনেকে যেমনটা পূর্বাভাস দিয়েছেন, সেভাবেই অর্থনীতির চেহারা বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় তা ভাল দেখিয়েছে। তবে যাই হোক না কেন, শেখ হাসিনার বৈধতা কখনই ততোটা শক্তভিত্তির উপর ছিল না, যেমনটা তিনি নিজে চিন্তা করে থাকেন। এবং তাই তিনি একদিকে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে জনসাধারণের চোখে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে চেয়েছেন।
বিরোধী দলের অধিকাংশ যে কারাবন্দি বা অন্তরীণ বা ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে, সেখানে ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর কেবল বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের ইংরেজি প্রেস থেকে এসেছে। যদিও বাংলাদেশী সম্প্রদায় নিশ্চিত নয়  যে, তাঁকে (শেখ হাসিনা) থামানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্ভবত অন্যপথ দেখতে আগ্রহী রয়েছে, তার কারণ তারা সম্ভবত ধরে নিয়েছেন যে, গণতন্ত্রায়নের জন্য বাংলাদেশ একটি হারানো বিষয়। যদি অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকে এবং বাংলাদেশ অকার্যকর হয়ে পড়ে তাহলে ভারতের হারাবার অনেক কিছুই রয়েছে কিন্তু তাকে এখনও পর্যন্ত নিরুদ্বেগ মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরোধী এবং সে বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে তাদের কাছে বিষয়টি উৎসাহব্যঞ্জক নয়। পাশ্চাত্য কি আদৌ পারে? তারা কি চেষ্টা করে দেখবে যাতে তাদেরকে জেলের বাইরে রাখা যায় এবং যাতে তাদের কোন ক্ষতি না হয় তেমন কোন একটা পথ অনুসরণে?
একজন সম্প্রতি লিখেছেন যে, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে প্রশিক্ষিত করেছেন, কি করে পীড়ন করা যায়, কি করে চরিত্র হনন করা যায়, কি করে মুক্তকণ্ঠকে স্তব্ধ করা যায়, ঠগামোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আন্দোলন (শাহবাগ আন্দোলনের মতো) কি করে সৃষ্টি ও বিলুপ্ত করা যায়। সৃষ্টি করা যায় বিরোধী দল, যেটি হবে তার সরকারের অংশ, যে দলের নেতারা তার মন্ত্রিসভায় বসবে। শাসক দলের পক্ষে ভোট দেবে। এই অজ্ঞাতনামা লেখক আরও লিখেন ‘তিনি বিশ্বের প্রথম স্বৈরতান্ত্রি ‘গণতন্ত্রের’ মডেল সৃষ্টি করেছেন।’ (আমি লক্ষ্য করি, এই লেখক তাঁর নাম লেখেননি। আমি এটাও লক্ষ্য করি যে, ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষমতা দেখানোর ক্ষেত্রে বিএনপি এতটা খারাপ ছিল না।)
আমার অনুমান, সুশীল সমাজের গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবর্গ এবং বিরোধীদল লড়াই ব্যতিরেকে নতি স্বীকার করবে না। শিগগিরই কিংবা পরে শান্তিপূর্ণভাবে একটি সরকারের পালাবদলের অনুপস্থিতিতে সহিংসতা হবে এবং তা যথেষ্ট মারাত্মক হতে পারে। আমরা আমাদের ভাবলেশহীনতার জন্য অনুশোচনা করতে পারি। সহিংসতার পরিণামে যেসব অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে তার মধ্যে সাধারণত সেনাবহিনীর ক্ষমতা দখল অন্যতম।
দি ফ্রাইডেটাইমস ডট কম থেকে অনূদিত

No comments

Powered by Blogger.