বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে ওরা by সালমান ফরিদ

‘সামনে-পেছনে পুলিশের গাড়ি। নিরাপদ ভেবে তন্দ্রাও এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ বিকট শব্দ। পরেই আগুনের ফুলকি। মুহূর্তে চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। ভাগ্য সহায় ছিল বলে কোন রকমে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। তাই এখনও বেঁচে আছি।’ কথাগুলো মিনারা বেগমের (২৩)। গত বুধবার রাতে রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তার পরিবারের ৯ সদস্যও দগ্ধ হন। ক্ষতের পরিমাণ গুরুতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেবা নিচ্ছেন বার্ন ইউনিটের পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে। কথা বলতে পারছিলেন না। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে যে সামান্য কথা হয়, সবটুকুই ছিল রাজনীতির প্রতি ক্ষোভ। চোখের সামনে পুড়েছে বাস। ঝলসে গেছে তার মুখ, হাত। পুড়ে ছাই হয়েছেন ৪ জন। মারা গেছেন তারই নিকটাত্মীয় একজন। আর একই ঘটনায় অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে বাড়িতে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তার সাড়ে চার বছরের শিশুকন্যা ফারজানা। সব মিলিয়ে ভয়াবহ ধকল যাচ্ছে তার উপর দিয়ে। বললেন, আমরা তো রাজনীতির কিছু বুঝি না। ক্ষমতায়ও যাব না। তাহলে কেন আমাদের পুড়ে মরতে হবে? মিনারার স্বামী ফজলুল হক। কাজ করেন জয়দেবপুরে স্কয়ারের গার্মেন্টে। স্ত্রী ঢামেকে ভর্তির পর থেকে তিনি সঙ্গে আছেন। তারও চোখে মুখে আতঙ্ক। কষ্ট চেপে রাখতে পারছিলেন না তিনি। বলেন, ২০ দিন আগে দাদর ইন্তিকালের খবর পেয়ে ঢাকা থেকে সবাই বাড়ি গিয়েছিলাম। পরে অবরোধ থাকায় মহিলাদের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। পুলিশের নিরাপত্তায় গাড়ি চলছে শুনে মঙ্গলবার রাতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন পরিবারের ১১ সদস্য। বেশির ভাগই নারী ও শিশু। কিন্তু এই নিরাপদ ভাবাটাই কাল হয়েছে। ঘটনার পর দগ্ধ ৯ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকজন ছাড়া পেলেও এখনও সেখানে ভর্তি আছেন ৩ জন। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় মিনারা ও ফুফু তসিরন বেগমকে (৬০) বুধবার রাতে মুমূর্ষু অবস্থায় নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিক্যালে। রাত ১০টার দিকে তারা হাসপাতালে এসে পৌঁছান। তবে এখানে আসার আগে রাস্তায় জীবনের মায়া ছেড়ে পরপারে চলে যান তসিরন। প্রাথমিক পরীক্ষায় সেই দুঃসংবাদ দেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। গতকাল সকালে লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, তারা কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে ঢাকায় আসছিলেন। উদ্দেশ্য গাজীপুরে যাওয়া। তার গ্রামের বাড়ি একই এলাকার পূর্ব লুকিয়াপাড়া। মিনারার শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার পুরো মুখ ঝলসানো। ফুলে বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা। বাম চোখ একেবারেই বন্ধ আর ডান চোখ মাঝেমধ্যে খুলতে পারছেন।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানান, এ পর্যন্ত চলতি অবরোধ ও হরতালে সহিংসতার আগুনে দগ্ধ ২২ জন এসে ভর্তি হয়েছেন এখানে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩ জন। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন আটজন। এর মধ্যে আইসিইউতে আছেন ১ জন, সিসিইউতে আছেন ২ জন। বাকিরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে সেবা নিচ্ছেন। এর মধ্যে কয়েক জনের অবস্থা শঙ্কামুক্ত নয়। বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ডা. সামন্ত লাল সেন গণমাধ্যমকে বলেন, যারা এখানে আছেন তারা ঝুঁকিমুক্ত নন। শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় তাদের বেশির ভাগই আশঙ্কায় রয়েছেন। তারা ভাল হলেও আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। হাসপাতালে থাকা অবরোধে আক্রান্ত রোগীরা নোংরা রাজনীতির বলি হওয়ায় ক্ষোভ ঝাড়েন দলগুলোর প্রতি। তাদের স্বার্থে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারায় নিন্দা জানান তারা। গত মঙ্গলবার রাতে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে হামলার শিকার স্বপ্না বেগমের (৩২) স্বামী মো. বাদশা বলেন, আমার স্ত্রীর তো কোন অপরাধ নেই। সে তো রাজনীতি করে না। তাহলে তাকে পুড়ে মরতে হবে কেন? রাজনীতির স্বার্থে আমরা গরিবরা কি বলি হবো? তিনি জানান, সিসিইউতে ভর্তি স্ত্রীর শরীরের ৫ শতাংশ পুড়েছে। তবে আক্রান্ত স্থান মুখমণ্ডল হওয়ায় অবস্থা এখনও সঙ্কটাপন্ন। তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, রাত ১টায় বাসটি মহাস্থানগড় পেরোনোর পর ককটেল ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। জানালার কাঁচ ভেঙে সেটি এসে পড়ে স্বপ্নার উপর। তার কাপড়ে আগুন লাগলে মুখ ও হাত ঝলসে যায়। এ সময় সঙ্গে থাকা তার মেয়ের জামাই মোমিনও দগ্ধ হন।
মারা গেলেন আবুল কালামও
এদিকে গত ৯ই জানুয়ারি রাজধানীর মগবাজারে প্রাইভেটকারে দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে দগ্ধ চালক আবুল কালাম (২৮) মারা গেছেন। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে তিনি ৪ তলায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই রাতে তিনি গাড়ির মালিকের আত্মীয়কে নিয়ে মগবাজারে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তাদের অপেক্ষায় পয়েন্টের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেখানে ঘুমাচ্ছিলেন কালাম। এ সময় ছাত্রশিবিরের দুর্বৃত্তরা এসে তার গাড়ির কাচ ভেঙে ভেতরে পেট্রোল বোমা ছুড়ে। এতে তিনি দগ্ধ হন। পুড়ে যায় তার মুখমণ্ডল, হাত, পা ও বুক। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্বাসনালী। পুড়ে যায় শরীরের ৩৩ শতাংশ জায়গা। গত ১১ই জানুয়ারি বিকালে এ প্রতিবেকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বেঁচে থাকার আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টার পরও তাকে বাঁচানো গেল না। তার বাড়ি বরিশালের আগৈলঝড়ার রামতা গ্রামে। পিতার নাম মৃত আব্দুল হক। তারা ৩ ভাই। তিনি সবার ছোট ছিলেন। ঢাকায় তিনি থাকতেন কলাবাগানে মালিকের বাসায়। চালাতের দৈনিক যায়যায়দিনের এক সাংবাদিকের প্রাইভেট কার। প্রথম দিকে তার অবস্থা একটু ভালোর দিকে হলেও শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চিকিৎসাকরা আশঙ্কার কথা জানান। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। অবরোধের বলি হয়ে তিনিও পাড়ি জমান শেষ যাত্রায়। গতকাল সন্ধ্যার পর তার লাশ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.