সমাবেশের জন্য অবরোধ- সাতচল্লিশের পরের নতুন ইতিহাস

চলতি অবরোধ বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে ইতিমধ্যেই নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সরকারের পতন নয়, স্রেফ একটি সমাবেশ করাকে কেন্দ্র করে এত বড় অবরোধ বাংলাদেশ রাজনীতির ইতিহাসে একটি সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা। বিএনপি একদফার আন্দোলনে ছিল না, এখনও নেই। তাদের নেতানেত্রীরা এমনকি মুখ ফুটে পারতপক্ষে বলেন না যে, তারা বর্তমানে সরকার ফেলে দেয়ার কোন আন্দোলন করছেন। তারা সরকারের পতন বা আগাম নির্বাচন দাবি করে কোন আলটিমেটামও দেয়নি। অথচ বাংলাদেশ রাজনীতিতে আলটিমেটাম ও ট্রাম্প কার্ডের রাজনীতি বহু পর্বে বারংবার ঘটেছে। কিন্তু তখন রাজনীতির এই একই পক্ষ-বিপক্ষ পরষ্পরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখায়নি। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা দুই নেত্রীকে যতটা দূরে সরিয়েছিল এক-এগারো তা তাদেরকে বেশ কাছাকাছি এনে দেয়। মাইনাস টু ফর্মুলার বিরুদ্ধে উভয় দল ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়। এমনকি শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার মতো পদক্ষেপ ও প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। এক-এগারোর পুরো দুই বছর এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এবারের মতো এতটা সরাসরি ও নির্দিষ্টভাবে সন্ত্রাসী দল হিসেবে গন্য করার প্রয়াস চালায়নি। সেদিক থেকেও এবারের ঘটনাবলী ব্যতিক্রম।  এটাও দেখার বিষয় যে, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলা আওয়ামী লীগের দায়ের করা মামলা নয়। এক-এগারোতে দায়ের করা মামলা, যা অনেকের মতে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে করা হয়েছিল, তার মাধ্যমে এখন বেগম খালেদা জিয়াকে কার্যত মাইনাস করার প্রক্রিয়াই চলছে। অন্তত প্রশ্ন উঠতে পারে যে, যা কিছু ঘটছে তা অসলে মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কি না। তাহলে অবশ্য এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, দেশের অন্যতম প্রধান জনপ্রিয় নেত্রীকে এভাবে কথিতমতে ‘মাইনাস’ করা সম্ভব হবে কি না?  অবশ্য এ রকম চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়দায়িত্ব সরকারি দল অন্তত সরাসরি নিচ্ছে না। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া আশির দশকের গোড়ায় প্রায় একই সময়ে রাজনীতিতে আসেন। তারা নিজেদের মধ্যে অনেক বৈরিতা, তিক্ততা, অবিশ্বাস ও বাদানুবাদ করার উদাহরণও সৃষ্টি করে রেখেছেন। কিন্তু অতীতের সেসব পর্বের চেয়ে ৫ই জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক ডামাডোলের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। কেবলমাত্র সমাবেশ করা ঠেকাতে তালা ঝোলানোর একটি নজিরবিহীন নজির সৃষ্টি করা রাজনীতি বোদ্ধাদের কাছে ছিল একটি অকল্পনীয় বিষয়। বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন অংশীদারদের মধ্যে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মতপার্থক্য থাকলেও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না, সেটা  বিদেশী বন্ধুদের কারও মতভিন্নতার বিষয় হতে পারে না। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২০ অনুচ্ছেদে, ইন্টারন্যাশনাল কোভেনান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের ২১ অনুচ্ছেদ, ইউরোপীয় মানবাধিকার কমিশন কনভেনশনের ১১ অনুচ্ছেদ এবং আমেরিকান মানবাধিকার কমিশন কনভেনশনের ১৫ অনুচ্ছেদ সমাবেশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এর আগে সরকারি দলকে বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে ব্রিফিং করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে দেখা গেছে। সেখানে সরকারি মহল বিরোধী দলের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনেছে এবং তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু এবারে তেমন কোন কিছুরও আলামত মিলছে না। কি কারণে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না, সে বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট অভিয়োগ আনা হচ্ছে না। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল চমকপ্রদ তথ্য দেন যে, ৫ই জানুয়ারি বেগম জিয়াকে না ঠেকালে ৫শ’ লোক নিহত হতো। অনেকের মতে, বিএনপির বিরুদ্ধে তীব্র দলীয় বক্তব্য প্রদানে বর্তমানে মন্ত্রিসভায় প্রতিযোগিতা চলছে। এই দৌড়ে তিনি এত দিন পিছিয়ে ছিলেন। গতকাল তিনি তাতে যুক্ত হলেন। তবে কি করে তিনি ঠিক ৫শ সংখ্যায় পৌঁছালেন, তার কোন বোধগম্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার কথা নতুন করে এই প্রশ্ন তুলছে যে, আইনমন্ত্রীর কথামতো বিএনপি যদি ‘সন্ত্রাস’ করে থাকে, তাহলে তিনি বা তার সরকার ভবিষ্যতে কখন কোন তারিখ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে সমাবেশ করার স্বাধীনতা ভোগ করতে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, তিনি চাইলে বাড়িতে চলে যেতে পারেন। এরপর ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেছিলেন, বেগম জিয়া বাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেন। কিন্তু তারপরও কয়েকটা দিন গড়িয়ে গেল। বেগম জিয়ার অন্তরীণ অবস্থা অবসানের তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আবার অবরোধ প্রত্যাহারেরও কোন লক্ষণ নেই। এর আগে ডিএমপির কর্তা বলেছিলেন, মৌলিক শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষে বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে তারা কোন লিখিত যোগাযোগে যেতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, বিএনপিকে তারা সন্ত্রাসী দল হিসেবে গণ্য করে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল নির্দিষ্টভাবে বললেন, বিএনপির কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসী। পর্যবেক্ষকদের অনেকে তাই আশঙ্কা করছেন যে, বিএনপিকে আওয়ামী লীগ তাহলে নিষিদ্ধ করতে চলছে কি না। এ বিষয়ে একেবারে নির্দিষ্ট করে কোন আইন তৈরির কোন পদক্ষেপ অচিন্তনীয় মনে হলেও এটা নিশ্চিত যে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বাস্তবে বিএনপি ও তার নেতাকর্মীর সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে তেমন আচরণই করছে। আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। অথচ কোন বৈধ আদেশ বা আদালতের কোন আদেশ ছাড়াই বিএনপি অফিসে তালা মারা হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়াকে অন্তরীণ রাখার ক্ষেত্রেও তালা ঝোলানোর ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসিচব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করার স্টাইলেও সরকারি দলের একই মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। রুহুল কবির রিজভীর ভূমিকা অতীতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই পালন করেছেন। অথচ আজ তাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়েছে। কারও কারও মতে, এটা পরিহাসমূলক যে,  বিএনপি একটি নিষিদ্ধ দল, এরকমের একটা পরিবেশ ফুটে উঠছে। কারণ, রিজভি সাংবাদিকদের কাছেও তার অবস্থান রাখছেন। কিন্তু তদুপরি যেটা লক্ষণীয় সেটা হলো গতকাল তিনি অজ্ঞাত স্থান থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বিজয় অর্জিত’ না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে। কিন্তু বিজয়ের সংজ্ঞা তিনি দেননি। এ রকম একটি বাতাবরণে দৃশ্যত কেবলমাত্র সমাবেশে বাধাদানের পরিণতিতে টানা অবরোধ কর্মসূচি পালনের ১০ দিন গতকাল অতিক্রান্ত হলো। ১৯৪৭ সালের পরে উপমহাদেশে এমন ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম।

No comments

Powered by Blogger.