১০ পয়সার ফুল

ফুল নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন যশোরের ফুলচাষিরা। গদখালীর কয়েক হাজার কৃষকের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে কোটি টাকার ফুল। নেই বেচাকেনা। বন্ধ বাজার আর পাইকারি ব্যবসা। ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার ফুল। অবরোধের কবলে পড়ে লোকসানের শিকার হয়েছেন গদখালীর ফুলচাষিরা। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় টানা হরতাল-অবরোধের কারণে ফুলের বাজারে বেচাকেনায় ধস নেমেছে। গদখালীর হাটে প্রতিটি লাল গোলাপ এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ পয়সায়। অথচ অবরোধের আগে প্রতিটি গোলাপের দাম ছিল ৫-৬ টাকা থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছিল ৮-১০ টাকায়। ফুলচাষিরা জানান, ১লা জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষের আগে থেকে হরতালের কারণে ফুলচাষিদের আশায় গুঁড়ে বালি পড়ে। এরপর ৫ই জানুয়ারি থেকে চলছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ। ফুলচাষিরা জানান, প্রতিবছরের মতো ১লা জানুয়ারিতে এ অঞ্চলের কৃষকদের দুই কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট ছিল। ফুলও তৈরি করা হয়েছিল সেইভাবে। কিন্তু হরতালের কারণে বিক্রি সিকিতে নেমে এসেছে। এছাড়াও বিএনপির ডাকা টানা অবরোধে আরও দুই কোটি টাকার লোকসানের শিকার হয়েছেন ফুলচাষিরা। গদখালী ফুল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, যশোর জেলায় কমপক্ষে ১০ হাজার কৃষক ফুল চাষ করেন। এর মধ্যে ঝিকরগাছা ও গদখালীতে রয়েছেন সাড়ে ৫ হাজার ফুলচাষি। এসব চাষির উৎপাদিত ফুল গদখালীর হাটে কেনাবেচা হয়। যা গোটা দেশের মোট ফুলের চাহিদার ৭০ ভাগ ফুল গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। এসব ফুলের অর্ধেক পাঠানো হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামে। বাকি অর্ধেক যায় উত্তরাঞ্চলে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, গোপালগঞ্জ ও বরিশাল এলাকায়। বিএনপির ডাকা অবরোধের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামে সামান্য কিছু ফুল পাঠানো সম্ভব হলেও অন্য কোন এলাকায় ফুল যাচ্ছে না। ফলে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার ফুল। তিনি আরও জানান, বিশেষ দিন ছাড়াও স্বাভাবিক সময়ে স্থানীয় গদখালী ফুলহাটে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। কিন্তু অবরোধের বাজারে গড়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকার ফুল বেচাকেনা হচ্ছে। গত ১৩ই জানুয়ারি গদখালীর ফুলহাটে গিয়ে দেখা মেলে ক্রেতাশূন্য বাজারের। বিক্রির জন্য চাষিরা ভোরে ক্ষেতের ফুল নিয়ে হাজির হলেও বেলা ১০টা পর্যন্ত একজন পাইকারও আসেনি। স্থানীয় ক্রেতারাও ফুল কিনছেন না। অগত্যা অনেক চাষি ফুল ফেলে যাচ্ছেন অন্য কাজে। স্থানীয় আড়তদার বা পাইকাররা বলছেন, অবরোধের কারণে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। ক্রেতারা আসতে পারছেন না। নেই কোন অর্ডার। গাড়ি চলছে না। ফলে ফুল কিনে পচানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এ কারণে তারা ফুল কিনছেন না। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধের বাজারে প্রতিটি গোলাপ ফুল বিক্রি হচ্ছে ১০ পয়সা। আগে যার দাম ছিল পিস  প্রতি কমপক্ষে ৫-৬ টাকা। একইভাবে রজনীগন্ধার স্টিক ৩০ পয়সা, গ্লাডিউলাস ফুল ২ থেকে ৩ টাকা, জারবেরা  প্রতি পিস ৩ থেকে ৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগের বাজার মূল্যের তুলনায় চার ভাগের একভাগ। পটুয়াপাড়ার ফুলচাষি সাহেব আলী জানান, তিনি এক একর জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন। কিছুদিন আগেও পাইকারি বাজারে প্রতি পিস গোলাপ ৪-৫ টাকা হারে ১০০ গোলাপ ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও গত কয়েক দিন ধরে গদখালীর বাজারে ১০০ গোলাপ ফুলের দাম যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকায়। একই উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের ফুলচাষি জয়নাল ৬০ শতক জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, নতুন ক্ষেত। এবছর থেকেই তার বেচাকেনা শুরু। ফুলও ধরেছে ব্যাপক। সাইজও আশানুরূপ। কিন্তু বাজারে চাহিদা নেই। বেচা বিক্রি হচ্ছে না। ফুলের জমিকেই তিনি সহায়-সম্বল হিসেবে মনে করলেও বর্তমান বাজার দাম দেখে তিনি ফুল ওঠানো বন্ধ করেছেন। ফলে জমিতেই ফুল নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি ও গদখালী ফুল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, গদখালীর ফুলচাষিদের উৎপাদিত ফুল সংরক্ষণের জন্য সরকারের কৃষি বিভাগ ২০১২ সালে একটি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের  প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে শর্ত ছিল, কোল্ড স্টোরেজ  তৈরির মোট টাকার শতকরা ২০ ভাগ কৃষকদের দিতে হবে। নিজেদের উপকারের কথা ভেবে সে শর্তেও রাজি হয় চাষিরা। তবে গত তিন বছরে কৃষি বিভাগের লোকজন আর এলাকায় যায়নি। এদিকে টানা অবরোধের কারণে মাথায় হাত চাষিদের। তবে এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ১০ পয়সা করেও ১টি গোলাপ বিক্রি হবে না।

No comments

Powered by Blogger.