অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত সেনাবাহিনী by কাজী সোহাগ

মুখোমুখি দুই পক্ষ। মাঝখানে নদী। আকাশে উড়ছে মিগ-২৯। জল ও স্থলে অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক। মুহুর্মুহু গুলি। এরই মধ্যে আহত সেনাসদস্যদের চিৎকার। পানির বাধা পেরিয়ে শত্রুর দখল করা জায়গা পুনর্দখল নিতেই এ যুদ্ধ। ৮ হাজার সৈন্যের অস্ত্রের ঝনঝনানি। এ চিত্রটি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীতকালীন মহড়ার। গতকাল রাজবাড়ীর প্রত্যন্ত অঞ্চল বালিয়াকান্দিতে সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হয় এ মহড়া। মিগ-২৯, এমআই-১৭ ও বেল-২০৬ বিমানের গোলাবর্ষণে মুহুর্মুহু কেঁপে উঠছিল মহড়ার স্থান। সেনাবাহিনীর পোশাক পরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে শেষ হয় অনুশীলন দুর্জয় বাংলার। ২১শে ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে টানা ২৬ দিন পর শেষ হয় সেনাবাহিনীর এ শীতকালীন মহড়া। অনুশীলন দেখাতে ঢাকা থেকে নেয়া হয় প্রায় ৮০ সংবাদকর্মীকেও। সেনাবাহিনীর কোন মহড়ায় বিপুলসংখ্যক সাংবাদিকের উপস্থিতি এটাই প্রথম। এদিকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস এডমিরাল মুহাম্মদ ফরিদ হাবিব, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারীসহ উচ্চপদস্থ সামরিক, অসামরিক ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক। বিএনপির জোটের ডাকা টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে অনুষ্ঠান ঘিরে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী। শুধু রাজধানী থেকে নেয়া হয় ৩০ সদদ্যের একটি গোয়েন্দা দল। সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় অন্য অতিথিদের নেয়া হয় অনুষ্ঠানস্থলে।
এদিকে অনুশীলন মহড়া শেষে যশোর অঞ্চলের তিন হাজার সেনাবাহিনীর সদস্যের দরবারে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে সেনাসদস্যদের পক্ষ থেকে কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১০ মিনিট তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, এ মহড়া ৫৫ পদাতিক ডিভিশন তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে। আমি নিশ্চিত, দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় যে কোন অশুভ শক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে আমাদের সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত রয়েছে। সেনাবাহিনী পেশাগত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দেশ ও জাতির প্রয়োজনে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে আসছে। গত নির্বাচনের সময় আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিরপেক্ষ ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে সহযোগিতা করেছে। তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা বাহিনী জয়ী হতে পারে যদি তারা মানুষের বিশ্বাস ও আস্তা অর্জন করতে পারে। আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য এটা যেমন প্রয়োজন, একইভাবে সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্যও প্রয়োজন। তিনি বলেন, একটি আধুনিক ও চৌকস সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর। এজন্য ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে ফোর্সেস গোল ২০৩০ প্রণয়ন করেছি। এটা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন এবং রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাজবাড়ী ও পটুয়াখালীর লেবুখালীতে সিনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ও নিরাপত্তার জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক সরঞ্জাম যেমন- এমপি গান, এটিজি ডব্লিউ, উইপেন লোকেটিং রাডার, এমবিআরএল, এআরভি এবং এমবিটি ২০০০ ট্যাংক সংগ্রহ করা হয়েছে। সেনাসদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীকেও ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর প্রতিটি স্তরে ইন্টারনেট সুবিধা দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে আর্মি ইনফরমেশন টেকনোলজি সাপোর্ট অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একইভাবে বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীকে আধুনিকায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। সেনাবাহিনীর জন্য নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার দায়িত্ব নেয়ার পর সেনাসদস্যদের রসদ বৃদ্ধি করে বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর সমান করেছি। এ ছাড়া অস্থায়ী কর্তব্য পালনের জন্য জেসিও ও অন্যান্য পদবির সৈনিকদের দৈনিক ভাতা, ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার এ দায়িত্ব পালনের দৈনিক ভাতা এবং এলপিআরের সময়কাল ৪ থেকে ৬ মাস বৃদ্ধি করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জেনে খুশি হয়েছি, আগের মতো এবারের প্রশিক্ষণেও আনসার এবং বিএনসিসি ক্যাডেটদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আধাসামরিক বাহিনী ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মাতৃভূমি রক্ষার এ কৌশল আমাদের সেনাবাহিনীর রণকৌশলকে ভিন্ন ও প্রশংসনীয় মাত্রা যুক্ত করেছে বলে মনে করি।
এদিকে অনুশীলন শুরু হওয়ার আগে বক্তব্য রাখেন ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ও যশোর এরিয়ার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, অ্যাসল্ট রিভার ক্রসিং অনুশীলন ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এতে অ্যাসল্ট ব্রিগেডের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল ১০৫ পদাতিক ব্রিগেড। এর অধীনে ১৭ বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট, ২২ বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি এবং ২৫ ইস্ট বেঙ্গল অ্যাসল্ট ব্যাটালিয়ন হিসেবে গড়াই নদী অতিক্রম করে। অনুশীলনের সার্বিক পারাপার কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত ছিল ৮ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন। এছাড়া ১২ ল্যান্সারের একটি স্কোয়াড্রন এবং ১৯ ইস্ট বেঙ্গল অনুশীলনে অংশ নেয়। এছাড়া ২৬ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি প্রত্যক্ষ ফায়ার সহায়তা এবং ২১ এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্ট আর্টিলারি আকাশ প্রতিরক্ষা দেয়। একই সঙ্গে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের চৌকস কমান্ডো দল, আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের হেলিকপ্টার এবং বিমানবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান অনুশীলনে অংশ নেয়।

No comments

Powered by Blogger.