প্রয়োজনে গুলি- সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন হচ্ছে

বিজিবি মানুষ হত্যা করতে চায় না। সে ধরনের নির্দেশও বিজিবির ওপর নেই। তবে মানুষ হত্যা করতে দেখলে এবং নিজে আক্রান্ত হলে জীবন বাঁচানোর জন যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করবে। আক্রান্ত হলে সে নিজের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। এটা তার অধিকার। মনে রাখতে হবে বিজিবির হাতে থাকা সব অস্ত্রই প্রাণঘাতী। গতকাল পিলখানায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি যদি পেট্রলবোমা ফাটায়, তাহলে ৫ জন লোক নিহত হতে পারে। এ দৃশ্য কোন বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ওই বোমাবহনকারীকে ‘ক্যাজুয়ালটি’ করা তার দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে কোন বোমাবাজকে গুলি করতে বিজিবি কুণ্ঠিত হবে না। মহাপরিচালক বলেন, ঢাকার বাইরে ৩৫টি জেলা থেকে বিজিবি চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৭টি জেলায় বিজিবি সদস্যরা সার্বক্ষণিক টহলে রয়েছেন। প্রতিদিন ৮০-৮৫ প্লাটুন বিজিবি কাজ করছে। বাকি জেলাগুলোর জন্য আরও ৭০-৭৫ প্লাটুন বিজিবি প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যাতে প্রয়োজন হলেই তারা যেতে পারেন। বিজিবি সদস্যরা কতদিন এভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, জানতে চাইলে মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ২০১৩ সালের কথা তো আপনাদের মনে আছে, সুতরাং আমরা মাসের পর মাস, যতদিন প্রয়োজন, সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করে যাবো। তিনি বলেন, পরিস্থিতি দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। আমি প্রতিদিন প্রতিবেদন পাচ্ছি। দু’-একটা রুটে সমস্যা আছে। তবে ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সমপ্রতি বিভিন্ন সময়ে বিজিবির গাড়ির পাশে ককটেল বিস্ফোরণের মতো ৩-৪টি ঘটনা ঘটলেও, তাতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। অবরোধের কারণে রাস্তায় যান চলাচলেও নিরাপত্তা দিচ্ছে বিজিবি। বুধবার রাতেও বিজিবির পাহারায় ৩৫ হাজার গাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেছে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে বিজিবি প্রধান বলেন, সীমান্ত রক্ষা আমাদের প্রাইম কাজ। কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষা করা, সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়া- এসব আমাদের সেকেন্ডারি কাজ। সুতারাং এ কাজে কোন সমস্যা হচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান পরিস্থিতি ছাড়াও বিজিবির গত বছরের কর্মকাণ্ডের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্তে কোন সমস্যা হলে তা তাৎক্ষণিক যোগাযোগে সমাধান করা যায়। গত জুন ও ডিসেম্বরে দুই দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠকের পর তাৎক্ষণিক যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। আগে মিয়ানমার কোন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে ধরতো না। আলোচনার পর তারা একবার দুই লাখ, আরেকবার চার লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। তবে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর চোরাকারবারিদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে যায় বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। বিজিবির প্রধান বলেন, ইয়াবাসহ একজনকে ধরে দেবো, কিন্তু কিছুদিন পর মুচকি হাসি দিয়ে বের হয়ে গেলে লাভ কি? আইনি দুর্বলতার কারণ এটা হচ্ছে না। এটা হচ্ছে সিস্টেমের জটিলতার কারণে। মহাপরিচালক জানান, বিজিবির জন্য ‘এয়ার উইং’ হচ্ছে। এজন্য চারটি হেলিকপ্টার কেনা হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিও পাওয়া গেছে। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের যেসব এলাকায় হেঁটে টহল দেয়া সম্ভব হয় না। সেসব এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে টহল দেয়া হবে। ভারত সীমান্তের ৩৪১ কিলোমিটার ও মিয়ানমার সীমান্তের ১৯৮ কিলোমিটার এমন জায়গা রয়েছে। বিজিবি প্রধানের এ সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির পদস্থ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন হচ্ছে
বিশেষ প্রতিনিধি জানান, সারা দেশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য দেশের সব জেলা প্রশাসন থেকে চিঠি পাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রথম দফায় ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েনের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে ছয় জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে ছয় জেলা ও তিন মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়। এদিকে কঠোর অবরোধ পালনকারী রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে সরকার। এসব জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক চেষ্টার পরও উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। এ কারণে গাইবান্ধা, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, রংপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জেলায় সাতক্ষীরার মতো যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়। চাঁপাই নবাবগঞ্জের পর অন্য  জেলাগুলোতে অভিযান চালাবে যৌথবাহিনী। এরই মধ্যে মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে অনুরোধ পত্র পাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যা নিয়ে এখন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। এদিকে মহাসড়কে দূরপাল্লার যান চলাচল নিরবচ্ছিন্ন রাখতে মহাসড়কে বসছে বিজিবি ক্যাম্প। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলা সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন জায়গায় এরই মধ্যে একটি অস্থায়ী বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ১৪ই জানুয়ারি পাঠানো চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একটি চিঠিতে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সীতাকুন্ড উপজেলার কুমিরায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। তাই যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তার সবই জনগণের স্বার্থে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রংপুরের মিঠাপুকুরে পেট্রোল বোমায় চার জনের মৃত্যুর ঘটনার পর পরই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ঘটনার দিনেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নতুন করে ৫৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন: বিজিবি মোতায়েন সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন আদেশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)- সহ ২০ দলীয় ঐক্যজোট এর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচিতে বিরাজমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারদের কার্যালয় থেকে বিজিবি ফোর্স মোতায়েনের চাহিদাপত্র পাওয়া গেছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখা, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার স্বার্থে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট/ পুলিশ কমিশনারদের কার্যালয় থেকে পাওয়া চাহিদা অনুযায়ী বিজিবি ফোর্স বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক মোতায়েনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এর মধ্যে গাজীপুরে চার প্লাটুন, নারায়ণগঞ্জে তিন প্লাটুন, কুষ্টিয়ায় তিন প্লাটুন, নীলফামারীতে দুই প্লাটুন, রাজশাহীতে তিন প্লাটুন, কিশোরগঞ্জে এক প্লাটুন, ঢাকা মহানগরে ৩০ প্লাটুন, খুলনা মহানগরে দুই প্লাটুন এবং চট্টগ্রাম মহানগরে ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করতে বিজিবি মহাপরিচালককে আদেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আগে জননিরাপত্তা রক্ষায় দেশের ২২ জেলায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। বিজিবি মোতায়েনকারী জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী, চাঁদপুর, নীলফামারী, বগুড়া,  নোয়াখালী, মেহেরপুর, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নাটোর, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, গাজীপুর, কক্সবাজার, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, পাবনা ও সাতক্ষীরা।
মহাসড়কে বসছে অস্থায়ী বিজিবি ক্যাম্প: প্রথম দফায় সীতাকুন্ডে বসছে বিজিবি’র অস্থায়ী ক্যাম্প। এরই মধ্যে সীতাকুন্ডে একটি অস্থায়ী বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এখন আরও একটি বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করতে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মেজবাহ উদ্দিন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগের জন্য সীতাকুন্ড উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মালামাল পরিবহনসহ অনেক যাত্রী প্রতিনিয়ত সীতাকুন্ডের উপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে যাতায়াত করে থাকেন। সীতাকুন্ড উপজেলা সদরে একটি বিজিবি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু মহাসড়কটির বিজিবি অংশের বিশালতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় কৌশলগত কারণে সীতাকুন্ড উপজেলা সদর ও চট্টগ্রাম সিটি গেইট এর মাঝামাঝি কুমিরাতে আরও একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। এরই মধ্যে সীতাকুন্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিজিবি’র পক্ষ থেকে কুমিরাস্থ গুল আহমদ জুট মিলসকে ক্যাম্প স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ওই জুট মিলসের সম্মতি রয়েছে। তাই অবরোধ কর্মসূচি চলাকালীন সময়ে কুমিরাতে একটি অস্থায়ী বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো। এদিকে অন্যান্য কয়েকটি জেলার ডিসিরাও অস্থায়ী বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।    
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে এপিসি সরবরাহের অনুরোধ: চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে চলছে যৌথবাহিনীর অভিযান। অভিযানের মধ্যেও গতকাল পুলিশের আইজি’র কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের জন্য একটি আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) চেয়েছেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদ। চিঠিতে তিনি বলেছেন, সোনা মসজিদ বন্দরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। প্রতিদিনই পণ্যবাহী শত শত ট্রাক ভারত থেকে এ বন্দরে আসে এবং সেগুলো থেকে মালামাল আনলোড করার পর ট্রাকযোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। সোনা মসজিদবন্দর থেকে পণ্যবাহী এসব ট্রাক পুলিশ ও বিজিবির সহায়তায় বন্দর থেকে ছাড়া হলেও রাস্তার পাশের আমবাগান থেকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক ট্রাকে পেট্রোল বোমা বা ককটেল ছুড়ে পণ্যসহ ট্রাকের ক্ষতিসাধনসহ ড্রাইভারকেও আহত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ১০-১২টি ট্রাক আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং ড্রাইভাররা আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবিরপন্থি এবং কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল হওয়ায় তারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের অপকর্মের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। তাই গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য শিবগঞ্জ এলাকার জন্য একটি এপিসি সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।

No comments

Powered by Blogger.