ভিওআইপি বন্ধে বাধা বিটিআরসি by কাজী সোহাগ

ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) বন্ধে এখন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) নিজেই। সরকারে থাকা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বিটিআরসি এ ধরনের ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়েছে। পাশাপাশি জড়িত নিজেদের গাফিলতি ও ব্যর্থতা।  এতে সরকার শ’ শ’ কোটি টাকা রাজস্ব হারালেও লাভবান হচ্ছেন ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীরা। বর্তমানে এ খাত থেকে ১৬শ’ কোটি টাকা আদায় হচ্ছে সরকারের। সংশ্লিষ্টদের মতে, ভিওআইপি বন্ধ করা সম্ভব হলে রাজস্ব আয় গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩২শ’ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম দিকে ভিওআইপি বন্ধ্যে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। এরই অংশ হিসেবে বিটিআরসি কেন্দ্রীয় পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা  (সেন্ট্রালাইজ মনিটরিং সিস্টেম-সিএমএস) স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে দরপত্রও আহ্বান করা হয়। শেষ পর্যন্ত ওই দরপত্র ভণ্ডুল করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দরপত্র বাতিলের জন্য বাজেট স্বল্পতার দোহাই দিতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিকে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিটিআরসির কয়েক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, প্রভাবশালীদের চাপে বিটিআরসি এ ভূমিকা নিয়েছে। তবে প্রভাবশালী কারা এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি তারা। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ কমিশন বৈঠকে আবারও নতুন করে সিএমএস দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর জন্য কোন ধরনের সময় সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগের দরপত্র প্রক্রিয়ার ভণ্ডুলের পেছনে প্রভাবশালীদের পাশাপাশি বিটিআরসির সংশ্লিষ্টদের অগাদ ব্যর্থতা রয়েছে। এর আগে বিটিআরসি ভিওআইপি বন্ধে জোর তৎপরতা চালায়। এরই অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি র‌্যাবের সহায়তায় অবৈধ ‘ভিওআইপি’ বিরোধী অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির হাজার হাজার সিমসহ শ’ শ’ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি জব্দ করেছে। জড়িত দেশী-বিদেশী অনেককে গ্রেপ্তারও করে। এমনকি সরকারি রাজস্ব ক্ষতি করে বারবার ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ের (আইজিডব্লিউ) সঙ্গে কল ‘টার্মিনেশন চার্জ’ ও কমিয়েছে। বর্তমানে বিটিআরসি তাদের আগের ভূমিকা থেকে সরে এসেছে। গত কয়েক মাস ভিওআইপি বন্ধে তেমন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না। দু-একটি বিচ্ছিন্নভাবে করা হলেও তা নামকাওয়াস্তে মাত্র। ভিওআইপির সঙ্গে কারা জড়িত এ নিয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা হয়েছে। গত বছরের ২৩শে নভেম্বর বিরোধীদলীয় এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাঘব বোয়ালরা জড়িত বলে অভিযোগ করেন। সংসদে কার্যপ্রণালী বিধির ৭১ বিধিতে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিশে তিনি এই অভিযোগ উত্থাপন করেন। সংসদে উত্থাপিত নোটিশে বিরোধী দলের ওই নেতা বলেন, ভিওআইপি লাইসেন্সের অপব্যবহার করে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী রাজধানীর বিভিন্ন ঘর-বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে অবৈধভাবে ভিওআইপি সরঞ্জাম স্থাপন করে বৈদেশিক কল চুরি করে যাচ্ছে। এসব অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাঘব বোয়ালরা জড়িত। এছাড়া বিটিআরসি ও বিটিসিএলের কিছু দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এর সঙ্গে জড়িত। নোটিশে তিনি ওই সব অবৈধ লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
সিএমএস টেন্ডার নিয়ে যা হয়েছে
গত বছরের এপ্রিলে ‘এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ বা (ইওআই) তৈরি করে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করা হলে ১৫ই মে ১৩টি কোম্পানি ‘আগ্রহ প্রস্তাব’ জমা দেয়। এর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়। এরা হচ্ছে- এসজিএস, সফরেকম, এসএস, কিনোট সিগোস, এশিয়া প্যাসিফিক, এনসফট, ডাটা সফটসিস্টেম, ঢাকা সার্ভিস কোম্পানি ও টেকট্রোনিক্স। ৭টি কোম্পানির মধ্যে ৫টি ১৫ই মে তাদের কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয়। কারিগরি মূল্যায়নে এনসফট ৮৯ দশমিক ৫, সফরকম ৭৮ এবং এসজিএস ৭১ দশমিক ৫ নম্বর পায়। ২টি প্রতিষ্ঠান ডাটা সফট ও ঢাকা সার্ভিস কোম্পানি কারিগরি মূল্যায়নে নির্ধারিত সর্বনিম্ন ৭০’র চেয়ে কম নম্বর পাওয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। প্রথমে ১৫ই জুলাই আর্থিক প্রস্তাব খোলার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়। পরে ৬ই আগস্ট আর্থিক প্রস্তাব খোলা হয়। সিএমসি স্থাপন ও ৩ বছর পরিচালনার জন্য এনসফট ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং এসজিএস ৫ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলার আর্থিক প্রস্তাব দেয়। শর্ত লঙ্ঘন করে বিকল্প আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করায় সফরেকমের প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
বিটিআরসির বক্তব্য
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার আলম মানবজমিনকে বলেন, আগের ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করে পরবর্তীকালে নতুন করে সিএমএস-এর জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। সে ক্ষেত্রে নিজেদের গাফিলতিও খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, এ পদ্ধতি আমাদের জন্য একেবারেই নতুন। আগের কোন অভিজ্ঞতাও নেই। ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের চাপে বিটিআরসি সিএমএস পদ্ধতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা হয়তো ঠিক নয়। টেন্ডার প্রক্রিয়ার শুরুতেই আমাদের কিছু ভুল ছিল। এদিকে অবৈধ ভিওআইপি আগের তুলনায় অনেক কম বলে দাবি করেন বিটিআরসির এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আগে চার থেকে সাড়ে চার কোটি মিনিট কল আসলেও এখন গড়ে কল পাওয়া যাচ্ছে ১০ থেকে ১১ কোটি মিনিট।

No comments

Powered by Blogger.