যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রলবোমা- ৯ জন আশঙ্কাজনক, ১৫ জনের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত by শেখ সাবিহা আলম

(পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ স্বামী আবুল হোসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে কাঁদছেন স্ত্রী রীমা বেগম। শুক্রবার রাতে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হন আবুল হোসেনসহ ২৮ জন l ছবি: সাহাদাত পারভেজ) দগ্ধ হওয়ার পর টানা ১০-১৫ মিনিট রাস্তায় দৌড়েছেন আবুল হোসেন (৩০)। পুড়ে যাওয়া চামড়া ঝুলে পড়ছে, মাংস খুলে খুলে পড়ছে শরীর থেকে। একপর্যায়ে আতঙ্কিত-হতবিহ্বল মানুষ আবুল হোসেনকে পৌঁছে দিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। গতকাল শনিবার বার্ন ইউনিটে আবুল হোসেনের ভাই মো. বিপ্লব হোসেন তাঁর ভাইয়ের বরাত দিয়ে বলছিলেন কথাগুলো। পাশে দাঁড়িয়ে আবুল হোসেনের স্ত্রী রিমা বেগম। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য স্পর্শ করতেই ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। কান্নার তোড়ে আর কথা বলতে পারলেন না। সাত বছরের ছেলে রিফাত নির্বাক মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। গাল বেয়ে যে চোখের পানি গড়িয়ে পড়েছে তার চিহ্ন স্পষ্ট। বার্ন ইউনিটে ৫ জানুয়ারি থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দগ্ধ হয়ে এসেছেন ৮৩ জন। এঁদের সবার জীবনের গল্প মোটামুটি একই রকম। অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক নিয়ে এঁরা ঘর থেকে বের হয়েছেন। বাড়ি ফেরেননি। দগ্ধ হয়ে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকেরা বলছিলেন, গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ীতে গুলিস্তান থেকে ভুলতাগামী গ্লোরী পরিবহনে পেট্রলবোমা হামলা সাম্প্রতিক সময়ের সব সহিংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে। এক সঙ্গে ২৯ রোগী, নয়জন আশঙ্কাজনক। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকেরা বলেছেন, ইউনিটে আসা রোগীরা শুধু দগ্ধই হননি, তিনজনের পা ভেঙে গেছে। কমপক্ষে ১৫ জনের চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নাক ও কানেও স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে। কত দফা এঁদের অস্ত্রোপচার লাগবে, কত জায়গায় লাগবে, আদৌ তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, সে নিয়ে সংশয়ে আছেন চিকিৎসকেরা। দগ্ধদের তালিকায় আছেন ফার্মাসিস্ট, চাকরিজীবী, খুদে ব্যবসায়ী, ছাত্র। এঁদের বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত। বার্ন ইউনিটের দোতলায় যাত্রাবাড়ীতে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ রোগীদের জন্য খোলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল গায়ে গায়ে রোগী, দর্শনার্থীর ভিড়। যাঁদের দগ্ধ হওয়ার পরিমাণ অল্প তাঁরা দিনভর সাক্ষাৎকার দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। কেউ গোঙাচ্ছিলেন, কেউ যন্ত্রণায় এতটাই ক্লিষ্ট যে খুব খেয়াল করে না দেখলে বোঝার উপায় নেই তিনি বেঁচে আছেন িক না। কারও কারও স্বজন একটানা কেঁদে চলেছেন, কখনো ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, কখনো বিলাপ করে উঠছেন।
বার্ন ইউনিটের দোতলার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ছুটে আসে এক কিশোর। নাম মিরাজ হোসেন। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। আকুল হয়ে জানতে চায়, ‘আমার আব্বু ভালো হবে? আচ্ছা সব রোগীর বিছানার কাছে লেখা ...শতাংশ বার্ন। এর মানে কী? বলেন না, আব্বু ঠিক হবে, আর আব্বুর মুখটা?’ মিরাজের বাবা মো. জাবেদ (৪২) গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকায় শুক্রবারও অফিসে যেতে হয়েছিল। তারপর দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে। একই সময়ে আবুল হাসনাত নামের এক ব্যক্তিকে দেখা গেল খুব জোরে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বাতাস করছেন ছোট ভাইটিকে। মো. সুমন তাঁর ভাই। শ্বাসতন্ত্র পুড়ে গেছে, গোটা মুখ পোড়া, চোখ বন্ধ। মনে হচ্ছিল এই বাতাসেই সব যন্ত্রণা জুড়াবে ভাইয়ের। মো. রুবেলের সঙ্গে গুলিস্তান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। ২৪ বছর বয়সী দুই বন্ধু, একটি অক্সিজেন কোম্পানিতে একই সঙ্গে চাকরি করেন দুজন। পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছেন। তবে মো. রুবেলের অবস্থা আরও সংকটজনক। শ্বাসনালিসহ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে। মো. রুবেলের ভাই মো. ইসমাঈল হোসেন প্রথম আলোকে জানান, দগ্ধ রুবেল বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যান। প্রাণের ভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকা মানুষেরা পোড়া এই মানুষটিকে মাড়িয়ে যান।
বসুন্ধরা সিটিতে একটি দোকানে কাজ করেন সালাউদ্দিন পলাশ (৩৬)। আঙুলের চামড়া ব্যান্ডেজের বাইরে ঝুলে ছিল। মুখ পুড়েছে, সারা শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া, পা ভাঙা। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। বারবার অস্বস্তির কথা জানাচ্ছিলেন স্ত্রী নাসরীনকে। দগ্ধদের তালিকায় আছেন ছাত্ররাও। তানবির তাঁদের একজন। মা রেখা বেগম ছেলের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। তিনি বললেন, কবি নজরুল কলেজ থেকে ফরম আনতে গিয়েছিল ছেলে। তালিকায় আছেন ফার্মাসিস্ট দম্পতিও। স্ত্রী সাঈদা ফাতেমাকে অফিসের কাজে শুক্রবার বেরোতে হবে শুনে স্বামী ইয়াসির আরাফাতও সঙ্গে আসেন। দুজনেই দগ্ধ। একজন দোতলায় অন্যজন একতলায় চিকিৎসাধীন। সাঈদার পুরো মুখ বিকৃত হয়ে গেছে, গায়ে-হাতে ব্যান্ডেজ। তিনি বলছিলেন, ‘স্টপেজে নামার জন্য দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আধা মিনিট পরেই নামতাম। ঠিক তখনই হামলা। আফসোসের শেষ নেই। বাড়িতে তাঁর এক বছর চার মাসের ছোট্ট সন্তান।’
এত কষ্টের মধ্যেও ক্ষোভের কথা জানালেন জামদানি শাড়ির কারিগর মো. হারিসের স্ত্রী হেনা। স্বামী বসুন্ধরায় শাড়ি দিতে এসেছিলেন। শ্বাসনালি পুড়ে গেছে তাঁরও। বলছিলেন, ‘তারা কি করতাছে, দুই নেত্রী? তামাশা দেখে? আর কত তামাশা দেখব?’

No comments

Powered by Blogger.