সৈয়দ আলীর প্যারালাইসিস হাসপাতাল- ওষুধ পায়ের চাপ, তেলপড়া, তাবিজ ও ফুঁ by মাহবুব খান বাবুল

সৈয়দ আলীর প্যারালাইসিস হাসপাতালে বিচিত্রসব চিকিৎসা দিচ্ছেন কবিরাজ। কখনও পায়ের চাপে পিষা হচ্ছে রোগীকে। কখনও বা দেয়া হচ্ছে তেলপড়া। কখনও ঝাড় ফুঁ। গত ২০ বছর ধরে এভাবেই তিনি চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে। কিন্তু এ হাসপাতালে এসে কেউ ভাল হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন এমন নজির মিলেনি একটিও। তারপরও মানুষ আসছেন। চিকিৎসা নিচ্ছেন। কবিরাজের নাম মো. সৈয়দ আলী। ভিজিটিং কার্ডে লিখেছেন আলহাজ্ব মো. সৈয়দ আলী আল-কাদরী কবিরাজ। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। বাড়ি সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের শিতাহরণ গ্রামে। তিনি ডাক্তারি বা কবিরাজিও পড়েননি। স্বাস্থ্য বিভাগের কোন অনুমোদন ছাড়াই বিটঘর বাজারে টিনের তৈরি ঘরে খুলে বসেছেন হাসপাতাল। নাম দিয়েছেন মাদানীয়া গাউছিয়া বাতেনিয়া সৈয়দীয়া দরবার শরীফ। মাসিক আয় দেড় লক্ষাধিক টাকা। মহিলা বা পুরুষের শরীরের যে কোন স্থানে পা দিয়ে চেপে ধরে ঝাড়ফুঁক করা তার চিকিৎসার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করেন তাবিজ ও তেল পড়া। সরজমিনে তার হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বিশাল বড় দু’টি টিনের ঘর। দূর-দূরান্ত থেকে নানা সমস্যা নিয়ে আসছে রোগী। নির্ধারিত ফি দিয়ে ভর্তি হচ্ছে।  বেশির ভাগ সিট মাটিতে। মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছে ভিন্ন বয়সের পুরুষ-মহিলা মিলে ৩০-৪০জন প্যারালাইসিস রোগী। ৫ থেকে ৮শ’ টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে ক্রয় করছেন পড়া তেল। পাশে বসে স্বজনরা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে তেল মালিশ করছেন। ঘরটির এক পাশে বাঁধা আছে বাঁশ। ওই বাঁশ ধরে ব্যায়াম করছেন রোগীরা। ঘরের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চৌকিতে বসে আছেন কবিরাজ সৈয়দ আলী। তার ঠিক পেছনে বসে আছেন চারজন হুজুর। তারা সিরামিকের প্লেটে লাল কালি দিয়ে বিরামহীন ভাবে লিখছেন তাবিজ। তাদেরকে মাসিক ভিত্তিতে দেয়া হয় বেতন। সৈয়দ আলীর সামনে একটি টেবিল। টেবিলে সাজানো রয়েছে তেল ভর্তি প্লাস্টিকের বোতল। একটু পরপর তেল ভর্তি বোতলে ফুঁ দিচ্ছেন। মাঝে-মধ্যে তার সামনে হাজির করা হচ্ছে রোগী। তিনি রোগীর হাতে ধরে টানছেন আর ডান পা দিয়ে রোগীর কোমরে কখনও পেটে চাপ দিয়ে ধরে ফুঁ দিচ্ছেন। আর বলছেন যা ভাল হয়ে যাবে। এখানে রয়েছে অনেকগুলো মাটির চুলা। রোগীরা নিজ খরচে বাজার করে পর্যায়ক্রমে রান্না করছেন। রয়েছে একাধিক টয়লেট। তবে এখানকার স্যানিটেশন ও হাইজেনিক ব্যবস্থা অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। সনদবিহীন ডাক্তার সৈয়দ আলীর চিকিৎসা সেবা নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক রোগী। ওই হাসপাতালে দেড় মাস ভর্তি থাকা ইসলামাবাদ গ্রামের আলী আকবর (৬০)সহ একাধিক রোগী বলেন, এখানে কোন চিকিৎসা হয় না। শুধু অনাচার। সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। খাওয়া ঘুমে আরাম নেই। ধোঁকা দিয়ে অর্থ  লোপাট করা হচ্ছে। ভর্তির সময় দিতে হয়েছে ৩ হাজার ২৭০ টাকা। সরিষার তেল এক বোতলের দাম ৮শ’ টাকা। সপ্তাহে লাগে দুই বোতল তেল। শুধু তেলের দামই দিয়েছি ৮ হাজার টাকা। আবার রয়েছে একটি দান বাক্স। সেখানেও দিতে হয় টাকা। আশুগঞ্জ চরচারতলার মো. ফাইজুর রহমান (৩০) বলেন, ১৮শ’ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছি আজ সাতদিন। কিছু বুঝতেছি না। মাধবপুরের শতানন্দ শর্মা (৭০) বলেন, এক বছর ধরে হাত ও মুখের একপাশ অবশ। ৭/৮শ’ টাকা দরে তিন ধরনের তেল দেন। দিনে ৪/৫ বার মালিশ করতে হয়। এখনও তেমন কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। সিলেট কানাইঘাটের আহসান হাবিব বলেন, এক গাড়ি চালকের কাছে খবর পেয়ে এখানে এসেছি। এখন একটু ভাল। সুলতানপুরের আবদুর রউফ (৪৮) বলেন, হঠাৎ শরীরের বাম পাশ অবশ হয়ে যায়। এরপর এখানে আসি। এখন কিছুটা আরাম মনে হচ্ছে। সরাইল ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মৃধা আহমাদুল কামাল বলেন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে টিনশেড ঘরে এমন জটিল রোগের চিকিৎসা চলতে পারে না। সনদ ও প্রশিক্ষণবিহীন লোকের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়-দায়িত্ব কে নিবে? আলহাজ্ব মৌঃ সৈয়দ আলী আল-কাদরী কবিরাজ রোগী ভর্তির সময় ২-৩ হাজার টাকা নেয়া ও তেল পড়া) বিক্রির কথা স্বীকার করে বলেন, রোগের ধরন বুঝে ভর্তি ফি নেয়া হয়। সব রোগীর ওষুধ লাগে না। এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু সালেহ মো. মুসা খান বলেন, এটা কোন চিকিৎসা নয়। মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঠকানো হচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক পন্থায় অনৈতিক ব্যবসার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শোষণ করা হচ্ছে। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, বিটঘর গ্রামের কথিত কবিরাজের আদিম পদ্ধতিতে টিনশেড ঘরকে হাসপাতাল বানিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি প্রচলিত আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.