‘মা আমি দেখতে চাই’

‘মা, মাগো। চোখে কিছু দেখতে পারছি না কেন। খুব ব্যথা করছে। জ্বালা করছে। চোখে আর কতদিন ব্যান্ডেজ থাকবে। সামনে আমার পরীক্ষা। কি থেকে কি হয়ে গেল। আমি কি আর চোখের আলো কোনদিন ফিরে পাবো না।’ হাসপাতালের বেডে শুয়ে বারবার এসব কথাই বলছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী হৃদয়। তার এমন কথা শুনে পাশে বসে থাকা নির্বাক হয়ে চোখের জল ফেলছিলেন তার মা রোজী আকতার। ঢুকরে কেঁদে উঠছিলেন পিতা আবুল খায়ের। বাইরে বারান্দায় বসে আদরের একমাত্র ভাইটির দিকে জানালা দিয়ে চেয়ে আছে বড় বোন। এই পরিবারের সবার উদ্বেগ এখন হৃদয়কে ঘিরে। গত সোমবার বিকালে ফেনী শহরে সন্ত্রাসীদের ছোড়া ককটেলের আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হয়ে এখন চট্টগ্রামের চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হৃদয়। পুরো নাম শাহরিয়ার হৃদয়। ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার সে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। গতকাল দুপুরে হৃদয়ের পিতার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তিনি তখন বারবারই তার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরছিলেন। পিতা আবুল খায়ের মানবজমিনকে বলেন, ছেলেটি যদি আর কোন কারণে চোখে দেখতে না পায় তাহলে আমার পরিবারের সব স্বপ্ন মুছে যাবে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর আমার পরিবারের সামর্থ্য নেই। ডাক্তার নিশ্চিত করে কিছু বলছেন না। ঘটনার পরপরই চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতালের ৩নং ওয়ার্ডের ৩০ নম্বর বেডে ভর্তি করানো হয় হৃদয়কে। ঘটনার বিবরণ দিয়ে ছেলেটির মা রোজী আকতার বলেন, সোমবার বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে আমার ছেলে প্রতিদিনের মতো প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরছিল। তার প্রিয় শিক্ষক ছিল বিজন স্যার। এ স্যারের কাছে হায়ার মেথ পড়তে গিয়েছিল সে। কিন্তু পড়তে গিয়ে তাকে দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে তাকে তা কোনদিন ভাবতে পারিনি। ঘটনার পরপরই আমরা তাকে ফেনীতে একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাই। সেখান থেকে অবস্থার বেগতিক হলে চট্টগ্রামে নিয়ে আসি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আহত হৃদয় তার মা রোজী রওশান আকতারকে বলছিলেন, আমি আর আমার এক বন্ধু স্যারের বাসা থেকে প্রাইভেট পড়ে ফেনী ট্রাংক রোডের মাথায় আসি। এরপর রিকশা ঠিক করছিলাম বাড়ি ফেরার জন্য। এমন সময় হঠাৎ ঘটে গেল ঘটনাটা। একটা ককটেল এসে সরাসরি আঘাত লাগে আমার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি মাটিতে পড়ে যাই। মাগো বলে চিৎকার দিই। তারপর আর কিছু মনে নেই। শুনেছি আমার সহপাঠীও গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ঢাকায়। হৃদয়ের পিতা আবুল খায়ের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, আহত হওয়ার পর ওর চোখ থেকে প্রচুর রক্ত বের হয়েছে। ডান চোখে আঘাত লাগায় অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। এ ছেলেটিকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন কি বাস্তবায়ন হবে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের। একটি দুর্ঘটনা আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি চাই। হৃদয়রা এক ভাই, দুই বোন। সে মেজো। তার বড়বোন তানজিনা আকতার পড়ছে ফেনী জিয়া মহিলা কলেজে। বারান্দার জানালা দিয়ে একটু পরপরই আদরের ভাইটির দিকে তাকাচ্ছিল সে। চোখের জল মুছছিল একাকী। নিশ্চয় ভাইয়ের অনেক কষ্ট হচ্ছে। সে কিছু বলছে না। কিন্তু আমি জানি তার কি হচ্ছে ভেতরটায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, আঘাত পাওয়ার পর গতকাল দুপুরে প্রাথমিকভাবে তার একটি অপারেশন করা হয়। এ সময় চোখে ১২টি স্প্লিন্টার লাগার কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। স্প্লিন্টার অপসারণ করলেও আঘাতের কারণে সে পুরোপুরি দেখতে পারবে কিনা তা নিশ্চত নন কেউই। আর তাই চোখের আঘাত শুকাতে ছেলেটিকে প্রতিদিনই এখন হজম করতে হচ্ছে অনেক ক্ষতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়েটিক ওষুধ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমরা ছেলেটির ব্যাপারে অনেক সচেতন। সামনে তার পরীক্ষা। এ সময় এ ধরনের আঘাত সত্যিই কষ্টের। তার চোখের অবস্থা ভাল নয়। পরবর্তী অবস্থা দেখে বলা যাবে আসলে সে কতটুকু দেখতে পারবে। তার চোখের বড় চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.