পুলিশকে ক্লান্ত করার কৌশল বিএনপির

সরকার সংলাপ-সমঝোতায় না আসা পর্যন্ত অবরোধ তুলবে না বিএনপি। তবে অবরোধের শিথিলতা ঠেকাতে ফাঁকে ফাঁকে হরতাল দেওয়া হবে। কর্মসূচি অব্যাহত রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘ক্লান্ত’ করা এবং সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, এই কৌশলের অংশ হিসেবেই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। চলমান অবরোধ আরও কঠোর করতে হরতালের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের কর্মসূচিও যুক্ত করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ছাত্রদল আজ বুধবার ও কাল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছে। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও দখলদারির প্রতিবাদে ছাত্রদল এ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান চলমান অবরোধে হরতাল ও ছাত্র ধর্মঘটের ডাককে আন্দোলনের ‘নতুন মাত্রা’ বলে মন্তব্য করেন। এর আগে ১২ জানুয়ারি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদদু আহমদ অবরোধের পাশাপাশি ঢাকায় ভিন্নধর্মী কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন।
বিএনপির দলীয় সূত্রগুলো জানায়, কোথাও কোথাও ঢিলেঢালা অবরোধ দলের নীতিনির্ধারকদের চিন্তায় ফেলেছে। বিশেষ করে সরকারের নানা তৎপরতায় রাজধানী ঢাকায় অবরোধ অগ্রাহ্য করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় বিএনপির শীর্ষ মহল উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় ঢাকাসহ মহাসড়ককেন্দ্রিক বিভিন্ন অঞ্চল ও জেলাভিত্তিক হরতাল ডাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে হরতাল ডাকা হয়েছে। ঢাকা ও খুলনা বিভাগের সব জেলায় আজ বুধবার সকাল ছয়টা থেকে শুক্রবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে ২০-দলীয় জোট। একই সঙ্গে আজ সকাল ছয়টা থেকে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলায় ৩৬ ঘণ্টার হরতাল দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, ১৫ দিনের টানা অবরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রায় বিরামহীন দায়িত্ব পালন করছেন। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ সদস্যরা একরকম হাঁপিয়ে উঠছেন। এভাবে আরও কিছুদিন হরতাল-অবরোধ চললে পুলিশ আরও ‘পরিশ্রান্ত’ হয়ে পড়বে। এরপর আন্দোলনের একটি পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের শক্তভাবে মাঠে নামার চিন্তা করা হচ্ছে।
বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, জোটের অবরোধ কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার তার দলীয় ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি সরকারি দলের নেতা-কর্মীদেরও মাঠে নামানো হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে যতই খুন, গুম, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন-নিপীড়ন চালাক, কৌশলগত দিক থেকে তারা এখনো জোট আছে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা প্রথম আলোকে জানান, গত ১৫ দিনের অবরোধ কর্মসূচিতে সরকারের তুলনায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা সে অর্থে তেমন শক্তি ব্যয় করেননি। অবরোধ ধরে রাখতে তাঁরা এখনো বিকল্প উৎসগুলো ব্যবহার করছেন। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা জানান, ১৯ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে সরকার খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশানের কার্যালয় থেকে বের করার কৌশল নিয়েছিল। ওই দিন তিনি জিয়ার কবরে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কার্যালয় থেকে বের হলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মতো গুলশানের কার্যালয়েও তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হতো বলে তাঁদের কাছে খবর ছিল। এ কৌশল থেকেই ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে হঠাৎ করে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ, জলকামান ও প্রিজন ভ্যানগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া সরকারের ‘ফাঁদে’ পা দেননি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ আন্দোলনে জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে এখনো সংশয়ে আছে। তারা মনে করছেন, চলমান কর্মসূচিতে বিশেষ করে ঢাকায় জামায়াতের তৎপরতা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। যদিও কয়েক দিনের মতো গতকালও জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহামন এক বিবৃতিতে অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখে ‘ব্যর্থ, অকার্যকর ও সন্ত্রাসী’ সরকারের পতন ঘটাতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
নতুন নির্বাচনের জন্য সংলাপের দাবিতে টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ চলে গেছে। সরকারও এর সমাধানে কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ না নিয়ে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনে নেমেছে। এ অবস্থায় বিএনপির টানা কর্মসূচি কত দিন টেনে নেওয়া যাবে বা দলের এসব কৌশল কতটা টিকবে, তা নিয়ে দলের নেতাদের কারও কারও মধ্যে সন্দেহ আছে। তবে কেউই এ বিষয়ে উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

No comments

Powered by Blogger.