শেলা নদীতে ভাসছে গুঁইসাপ, মাছ কাঁকড়া ক্ষতিগ্রস্ত ডলফিনের বসতি by রাশিদুল ইসলাম ও একে আজাদ

শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির কারণে সুন্দরবনের প্রায় ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। গত ৬ দিনে জোয়ার-ভাটায় এই তেল ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। তবে বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর ও শেলা নদীর মাঝখান থেকে তেলগুলো স্থানীয় জনগণের সহায়তায় কিছুটা সরে গেছে। নদী দু’টির সঙ্গে যুক্ত শতাধিক খালের মধ্যেও এই তেল ঢুকে পড়েছে। লোকদেখানো তেল অপসারণ করার কাজে ব্যস্ত সরকারের পক্ষ ও বন বিভাগ। এদিকে সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগের  বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, সোমবার দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটি পানির পাম্প (শ্যালো মেশিন) দিয়ে গাছের গায়ে ও ঘাসের ওপর লেগে থাকা তেল ধুয়ে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। পরে ওই তেল স্থানীয় প্রযুক্তিতে ধারণ করা হবে। তিনি বলেন, শরণখোলা ও বগী এলাকা থেকে কচুরিপানা আনা হয়েছে। ওগুলো নদীর তীরে এবং খালের মধ্যে ফেলা হবে- যাতে তেল চুষে যায়। কয়েক দিন পর ওই কচুরিপানা উঠিয়ে অন্যত্র ফেলে দেয়া হবে।
গুঁইসাপ, মাছ, কাঁকড়া মারা যাচ্ছে: তেলের বিষাক্ততায় সুন্দরবনের করমজলে মারা গেছে গুঁইসাপ। মরছে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছ আর কাঁকড়া। আর তেলে আক্রান্ত গাছ ও ঘাসগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। সুন্দরবনের বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ফার্নেস অয়েলের প্রভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারও আক্রান্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা বনপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের। দেশের একমাত্র বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র সুন্দরবনের করমজলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে একটি মৃত গুঁইসাপ পড়ে আছে। গুঁইসাপের ছবি তুলতে দেখে সেখানকার কয়েকজন কর্মী ও দর্শনার্থী ছুটে যায়। আস্তে আস্তে  ভিড় বাড়তে থাকে মৃত গুঁইসাপকে ঘিরে। এ ব্যাপারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত  কমিটির সদস্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, নদী সংলগ্ন এলাকায় এই ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের যেসব গাছপালায় তেল লেগেছে সেগুলোও অক্সিজেন না পেয়ে ধীরে ধীরে মারা যেতে পারে। পাখির পালকে এই তেল লাগলে সেগুলো আর উড়তে পারবে না। পালক ঝরে যাবে। নতুন করে আর পালক না-ও গজাতে পারে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ডলফিনের বসতি: সুন্দরবনের শেলা নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেলের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ডলফিনের অভয়াশ্রম হিসেবে চিহ্নিত চাঁদপাই এলাকা। ঢাংমারী ও দুধমুখী অভয়ারণ্য এলাকা মাঝারি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকার সাতটি পয়েন্ট বা এলাকা ও শরণখোলা রেঞ্জের ছয়টি এলাকার বৃক্ষে ওই তেলের প্রভাব পড়েছে। ছড়িয়ে পড়া তেল সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপরে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে, তার প্রাথমিক হিসাব করে এসব তথ্য জানিয়েছে বন বিভাগ। জেলেরা গুজব ছড়িয়ে গত রোববার শেলা নদীতে একাধিক মরা ডলফিন দেখার কথা জানিয়েছেন অনেক মিডিয়া কর্মীদের কাছে। তবে বন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল পর্যন্ত কোন জলজ প্রাণীর মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারেনি কেউ। ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারের ছড়িয়ে যাওয়া তেলের তেজস্ক্রিয়তার ফলে ডলফিনের ক্ষতিকারক হিসেবে ওয়ার্ল্ড লাইফ কনজারভেটিব সোসাইটির প্রধান রুবায়েত মুনসুর জানান, যে এলাকায় ট্যাঙ্কারটি ডুবেছে সেই এলাকা ইরাবতিসহ ৬ প্রকারের ডলফিনের অভয়ারণ্য এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা এলাকা। এতে বনজ ও জলজ প্রাণীদের মধ্যে সব চেয়ে ডলফিনেরই বেশি  ক্ষতি হয়েছে। ট্যাঙ্কার ডুবির সঙ্গে সঙ্গে তেলের তেজস্ক্রিয়তায় ডলফিনের চলাফেরা ও বিচরণ স্থান পরিবর্তন করেছে। তবে পানির অক্সিজেন পরিবর্তন হওয়ায় এখন আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে তারা।
পশ্চিমবঙ্গ বনবিভাগকে সতর্ক থাকার নির্দেশ: সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত। দেশটির বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক প্রদীপ জানান, ছড়িয়ে পড়া তেল যাতে ভারতের সুন্দরবনের অংশে চলে না আসে সেজন্য পশ্চিমবঙ্গ বন বিভাগকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সুন্দরবন রক্ষায় কাজ করছে সুন্দরী প্রকল্প: করমজল, মংলার কাছাকাছি জয়মনীর ঘোলে ডুবে যাওয়া তেলের ট্যাঙ্কারটি সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ এবং সুন্দরবনের উপরে নির্ভরশীল জীবিকাসমূহের উপরে মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের দিনের মতই বাংলাদেশ বন বিভাগ ১৫০টি নৌকা এবং প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়ে ছড়িয়ে যাওয়া তেল সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে জাগ্রত যুব সংঘ (জেজেএস)-কে সুন্দরী প্রকল্পের ব্যানারে নন্দবালা ফরেস্ট স্টেশনের জীববৈচিত্র্য ও জীবিকা রক্ষার উদ্দেশ্যে শেলা ও পশুর নদীসহ আশপাশের চর, খাল এবং নালাসমূহ হতে তেল পরিষ্কার ও সংগ্রহ এবং আবর্জনা সরিয়ে নিতে দেখা যায়।
বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচি: মানবসৃষ্ট দুর্যোগের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য স্মারকলিপি প্রদান করেছেন সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলন। সোমবার দুপুরে খুলনা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর এ স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় পূর্বাঞ্চল ডায়লগ সেন্টারে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), জন উদ্যোগ, বারসিক ও ক্লিন-এর অয়োজনে ‘সুন্দরবনের জীবন বাঁচাতে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক হয়।

No comments

Powered by Blogger.