মায়ের লাশের অপেক্ষায় রুনা by রোকনুজ্জামান পিয়াস

মায়ের লাশের অপেক্ষায় এখন দিন কাটে কলেজপড়ুয়া রুনার। জন্মের পর বাবাকে দেখেননি। মা-ই তাকে বাবা-মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। ১৫ বছর আগে স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ার পর মা কুলসুম আক্তার একমাত্র মেয়েকে অবলম্বন করেই বেঁচে ছিলেন। সুপাত্র ভেবে বিয়ে দিয়েছিলেন প্রবাসী ছেলের সঙ্গে। মেয়ের ভাগোন্নয়নে বেয়াইয়ের মাধ্যমে নিজেও পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর মালয়েশিয়ায়। কিন্তু মেয়ের ভাগ্যোন্নয়ন তিনি করতে পারেননি। বরং একমাত্র মেয়েকে এতিম করে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। হতভাগী সেই মায়ের ঠিকানা এখন মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালের মর্গে। লাশ হয়ে গত দেড় মাস সেখানেই পড়ে আছেন তিনি। এদিকে, এতিম রুনা অপেক্ষায় আছেন অন্তত শেষবারের মতো মাকে দেখার। রুনা বলেন, আমি মাকে দেখতে চাই, কিন্তু কিভাবে আসবে মা? তার শ্বশুর এক লাখ টাকা চেয়েছেন লাশ ফেরত পাঠানোর জন্য। কিন্তু আমরা তো এখন নিঃস্ব, ওই টাকা কিভাবে যোগাড় করবো?
সূত্র জানায়, পারিবারিক পরিচয়ের সূত্র ধরে ২০১২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর কুলসুমের মেয়ে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় শারমিন আক্তার রুনার বিয়ে হয় মালয়েশিয়া প্রবাসী মামুনের সঙ্গে। মামুনের পিতা মুন্সীগঞ্জের আবুল হোসেন ব্যাপারীও মালয়েশিয়া প্রবাসী। তার মাধ্যমেই গত ২৩শে মে কুলসুম আক্তার আড়াই লাখ টাকা চুক্তিতে টুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়া যান। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে বেয়াইয়ের হাতে তুলে দেন নগদ ২ লাখ টাকা। কুলসুমের ভাই রিপন জানান, পরে বেশ কিছুদিন নিখোঁজ থাকার পর মালয়েশিয়া থেকে বাড়িতে ফোন করেন তিনি। ওই সময় কুলসুম জানিয়েছিলেন, মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর এয়ারপোর্ট থেকে তাকে তার বেয়াই আবুল হোসেন গ্রহণ করে একটি হোটেলে রেখে আসেন। তারপর উধাও হয়ে যান। এরপর আবুল হোসেনের নাম্বারে যোগাযোগ করলে মোবাইলটি বন্ধ পান কুলসুম। ৩ দিন পর ওই নম্বরে যোগাযোগ হলে আবুল হোসেন বলে তার মোবাইলটি পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে বলে- তার এক বন্ধু তার জন্য কাজ ঠিক করেছে । পরদিন বেয়াইয়ের বন্ধু লোকটি তাকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে সব কিছুই ছিল তার অজানা-অচেনা। ওইখানে রেখে, লোকটিও উধাও হয়ে যায়। ওই সময়ই কুলসুম বাড়িতে ফোন করে তার দুর্দশার কথা জানান। তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, তাকে ৫/৬ দিন সেখানে আটকে রাখা হয়েছে। গোসল করতে পারছেন না। দেয়া হচ্ছে না কোন খাবার। কুলসুম আরও জানান, তাকে ৩ মাসের ভিসা দেয়ার কথা বলে দিয়েছে ১ মাসের। এরপর আর তার সঙ্গে কথা হয়নি। এদিকে আবুল হোসেনও তার পরিবারের কাছে বাকি টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। সে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে বলে টাকা না দিলে তার মান সম্মান থাকছে না। পরে রিপন নিজে গিয়ে ওই টাকা ম্যানেজ করে বায়তুল মোকাররম এলাকার একটি কার্পেটের দোকানে দিয়ে আসেন। রিপন জানান, টাকা দেয়ার পর ডকুমেন্ট চাইলে দোকানের মালিক পরিচয় দেয়া লোকটি টাকা ছুড়ে ফেলে। ওই সময় মালয়েশিয়া থেকে আবুল হোসেন ফোন করে ডকুমেন্ট লাগবে না বলে জানিয়ে দেয়। বেয়াইয়ের কথামতো সরল বিশ্বাসে তিনি ডকুমেন্ট না নিয়েই ফিরে আসেন। এভাবে এক মাস কেটে যায়। পালিয়ে বেড়াতো। আবুল হোসেন তার খবর জানে না বলে জানিয়ে দেয় পরিবারকে। গত কোরবানির ঈদের দিন আবারও ফোন করেন কুলসুম। তিনি তখন জেলখানায় আটক। বলেন, এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়ানোর এক পর্যায়ে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যাওয়ার পথে কুয়ালালামপুরের একটি মার্কেটের সামনে থেকে অবৈধ বসবাসের দায়ে কুলসুমসহ আরও ৭ নারীকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে কুলসুম ছাড়াও মনোয়ারা নামে আরও এক বাংলাদেশী নারী ছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিল ভারতীয় এক নারীও। কুলসুম জানায়, তাকে ৭ দিনের জেল দেয়া হলেও এক মাসেও তিনি মুক্তি পাননি। শঙ্কিত হয়ে তিনি বলেন, তার শারীরিক অবস্থা ভাল না। পা ফুলে গেছে। চিকিৎসা চাইলেও হাজতখানায় তার চিকিৎসা দেয়া হয়নি। এদিকে গত ৩রা ডিসেম্বর দেশে ফিরে এসেছেন একই সঙ্গে হাজত বাস করা ঢাকার কমলাপুর এলাকার মনোয়ারা। তিনি ৬ই ডিসেম্বর খুঁজে বের করেছেন কুলসুমের স্বজনদের। বলেছেন, কুলসুম এখন লাশ হয়ে পড়ে আছে সেখানকার একটি হাসপাতালের মর্গে। লাশের ব্যাপারে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সিলর  (লেবার উইং) সাইয়েদুল ইসলাম ভূঁইয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পোর্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানা যাবে। পরে রিপোর্ট অনুযায়ী এব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.