শিশুর রক্তে স্নাত পাকিস্তান

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে জিম্মি নাটকের অবসান হতে না হতেই শিশুদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠল পাকিস্তান। দেশটির খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত এক স্কুলে জঙ্গি হামলায় ১৪১ জন নিহত ও ১২২ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১৩২ স্কুলশিক্ষার্থী। হামলাকারী ৯ জঙ্গিও নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন। আহতের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশংকাজনক। হামলার দায়িত্ব তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) স্বীকার করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী জিম্মি শিশুদের উদ্ধার করে অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করেছে। এ ধরনের কাপুরুষোচিত হামলার প্রতিবাদে সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এএফপি, ডন, বিবিসি। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ৭ থেকে ৯ জঙ্গি ওই স্কুলে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় প্রবেশ করে। তারা ভেতরে প্রবেশের আধা ঘণ্টার মধ্যে গুলি করা শুরু করে। এতে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে জঙ্গিদের গুলি বা আÍঘাতী বোমায় এত শিশুর মৃত্যু হয়েছে না নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের বন্দুকযুদ্ধের মাঝে পড়ে এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। হামলা শুরুর আগে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেডিকেল দলের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর একটি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। হামলা শুরু হলে তারা বুঝে উঠতে পারেনি কি ঘটনা ঘটছে। ইরশাদা বিবি নামে এক নারীর ১২ বছরের এক সন্তান এ হামলায় নিহত হয়েছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, হে আল্লাহ! কেন আমার সন্তানের এ অবস্থা হল। কেন এত অল্প বয়সে আমার সন্তানের মৃত্যু দেখতে হল।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এক বিবৃতিতে জিম্মি হওয়া শিশুদের নিজের সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাদের উদ্ধারে চালানো অভিযান নিজেই তদারকি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান। নওয়াজ শরিফ পেশোয়ারে পৌঁছে বলেন, দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। তিনি এ হামলার ঘটনায় দেশের মানুষকে মনোবল না হারাতে বলেন। নওয়াজ শরিফ এ ঘটনায় আজ পেশোয়ারে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন।
প্রতিবেশী দেশ ভারত এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দেশটি দোষীদের বের করে শাস্তির আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
টিটিপি হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে জানিয়েছে, বদলা নিতে এ হামলা করা হয়েছে। টিটিপির মুখপাত্র মুহাম্মদ খোরাসানি বলেন, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সেনা অভিযানের প্রতিশোধ নিতেই এ হামলা চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, স্কুলের ভেতর সাত তালেবান যোদ্ধা প্রবেশ করেছে এবং তারা আত্মঘাতী হামলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তবে তিনি দাবি করেন, তাদের স্কুল শিক্ষার্থীদের নয়, সেনা সদস্যদের গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
স্কুলে কতজন শিক্ষার্থী জিম্মি ছিল সে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, স্কুলের ভেতর শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৫০০ জন জিম্মি ছিলেন। হামলার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা স্কুলটির চারপাশে অবস্থান নেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ অভিযান চালানো হয়।
খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ক্ষমতায় আছে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ। ইমরান খান ওই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পারভেজ খাত্তাকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দ্রুত ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ১৮ ডিসেম্বর দেশব্যাপী তার দলের বিক্ষোভ কর্মসূচিও স্থগিত করেছেন।
খাইবার পাখতুনখাওয়ার মুখ্যমন্ত্রী পারভেজ খাত্তাক বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ইউনিফর্ম পরে জঙ্গিরা স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করে।
সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র জেনারেল অসীম বাজওয়া বলেন, হামলা শুরুর সাড়ে ৫ ঘণ্টার মধ্যে স্কুল বিল্ডিং থেকে সব জঙ্গিকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর সব জঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছে।
স্কুলটি পাকিস্তানের আর্মি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। দেশজুড়ে এমন ১৪৬টি স্কুল আছে। সেনাসদস্য ও বেসামরিক নাগরিকদের সন্তানরা এখানে পড়াশোনা করে। এখানে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের বয়স ১০-১৮ বছর। স্কুলটির শিক্ষকদের বেশির ভাগ সেনা সদস্যদের স্ত্রী।
পেশোয়ারের লেডি রিডিং হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, অন্তত ১৩২ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে সেনাসদস্য, স্কুলের নিরাপত্তা প্রহরী এবং শিক্ষকও রয়েছেন।
লেডি রিডিং হাসপাতালের চিকিৎসক শিরফ খান জানান, তাদের কাছে তিনজন শিক্ষার্থীর মরদেহ এসে পৌঁছেছে। আহত ৩৫ জনকে সেখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে দুজন ওই স্কুলের শিক্ষক। চিকিৎসাধীন দুই চিকিৎসকের বরাত দিয়ে হাসপাতালের কর্মকর্তা ইজাজ খান বলেন, অস্ত্রোপচার কক্ষে নেয়া অনেকের অবস্থা আশংকাজনক। পেশোয়ারের হাসপাতালগুলোতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। হাসপাতালগুলো ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত দেয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক শিক্ষক জানান, হামলাকারীরা হামলার জন্য পরীক্ষার সময়কে বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, হামলার আধা ঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি স্কুলে তালেবান হামলায় শতাধিক স্কুলছাত্রসহ নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল জানান, বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বর্বর ও ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড সারা বিশ্বের মানুষকে শোকাহত ও স্তম্ভিত করেছে। তিনি এ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তিরোধে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ হামলায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
খালেদা জিয়ার নিন্দা ও প্রতিবাদ : পেশোয়ারে এ হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, তালেবানের এ ধরনের হিংস্রতা বিশ্বের শান্তিময় পরিবেশকে অশান্ত করার উদ্দেশ্যই করা হয়েছে। বর্বরোচিত হামলা ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। ধর্মের নামে অসহায় ও নিরীহ শিশু-কিশোরদের ওপর এ ধরনের হামলা ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড সমগ্র বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পাকিস্তানে নিহত শিক্ষার্থীদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। আলাদা বিবৃতিতে তালেবান হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও।

No comments

Powered by Blogger.