পাকিস্তানে তালেবান বর্বরতা- শতাধিক স্কুলছাত্রসহ নিহত ১৪৫, তিন দিনের শোক

তালেবানের নৃশংস হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে পাকিস্তানের একটি স্কুল। হামলাকারীরা শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের একের পর এক গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় শ্রেণীকক্ষ ভেসে যায় রক্তে। আহতদের আর্তনাদে সৃষ্টি হয় এক মর্মন্তুদ দৃশ্য। হামলায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১৪৫ জন। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০০ জন শিক্ষার্থী। তাদের বয়স ১৬ বছর বা তার কম। নিহত অন্যরা হলেন শিক্ষক। হামলাকারীদের কয়েকজনও নিহত হয়েছে। আহতদের অনেকের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। ফলে নিহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ঘটনায় সারাদেশে ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা ওই স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রদের জিম্মি হিসেবে আটক রেখেছিল। তাদের উদ্ধারে চলছিল অভিযান। স্কুলের ভেতর থেকে সন্ধ্যার দিকে পাওয়া যায় কমপক্ষে ১৫টি বিস্ফোরণের শব্দ। ফলে ভেতরে যাদেরকে জিম্মি করা হয়েছে তাদের পরিণতি কি তা জানা যায় নি। এ অবস্থায় পেশোয়ারে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা করেন সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফ। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ হামলাকে ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ঘটনাকে নারকীয় বর্বরোচিত বলে আখ্যায়িত করেছেন পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান।
গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ১০টার দিকে পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত আর্মি পাবলিক স্কুলে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই স্কুলের অডিটরিয়ামে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল সেনাবাহিনীর একটি দল। অকস্মাৎ তখন ওই স্কুলের দেয়াল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়ে তালিবান  সন্ত্রাসীরা। তারা সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কক্ষে ও অবস্থানে গিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। স্কুল থেকে ৫০০ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগকেই উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। অনলাইন ডন ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও পাকিস্তানের পরাজয়ের দিকে ইঙ্গিত করে শিরোনাম করে- এনাদার ডিসেম্বর ১৬, এনাদার ব্ল্যাক ডে। তালিবান মুখপাত্র বলেছে, সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালনা করেছে তার জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী উত্তর ওয়াজিরিস্তান ও পার্শ্ববর্তী খাইবার এলাকায় তালেবানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে।
ধারণা করা হয়, তাতে কয়েক শ’ তালিবান যোদ্ধা নিহত হয়েছে। তারই বদলা নিতে তারা গতকাল ওই হামলা চালিয়েছে। মুদাসসির আওয়ান নামে ওই স্কুলের এক কর্মী বলেছেন, তিনি স্কুলের দেয়াল টপকে ৬ জন ব্যক্তিকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখেন। প্রথমে তিনি মনে করেছিলেন শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো খেলার অংশ হিসেবে দেয়াল টপকাচ্ছে। মুদাসসির আওয়ান বলেন, এরপরই দেখতে পাই তাদের সঙ্গে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র। তারা  ভেতরে প্রবেশ করেই গোলাগুলি শুরু করে। এ সময় স্কুল থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর্তনাদ। ঘটনার পর পরই সেখানে অভিযান চালায় আধা সামরিক বাহিনী। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্য নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন।
এতে আধা সামরিক বাহিনীরও কয়েকজন নিহত হয়েছেন। এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উচ্চস্বরে সাইরেন বাজাতে বাজাতে ছুটে যায় এম্বুলেন্স। আহতদের নিয়ে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালের উদ্দেশে ছুটে যায় তা। আকাশে টহল দিতে থাকে হেলিকপ্টার। এ সময় বন্ধ করে দেয়া হয় পেশোয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক। উল্লেখ্য, ওই স্কুলটি পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্টের এক পাশে। এতে পড়াশোনা করে মূলত সেনাবাহিনীর সদস্যদের ছেলেমেয়েরা। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই স্কুলে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত ছিল। সেনাবাহিনী স্কুল ভবনটি ঘিরে রেখেছে। তেহরিকে তালিবান পাকিস্তান বলেছে, এ হামলা চালিয়েছে তাদের আত্মঘাতী বোমারুরা। তাদের মুখপাত্র মুহাম্মাদ খোরাসানি বলেছেন, হামলাকারীদের তারা যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, শিশুদের হত্যা করা যাবে না। শিশু নয় এমন শিক্ষার্থীদের হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সেনাবাহিনীর ওই স্কুলকে বেছে নিয়েছি। এর কারণ, সরকার আমাদের পরিবার ও নারীদের টার্গেট করেছে। আমরা এই হামলা চালিয়ে তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি বেদনা কেমন হয়। ওদিকে লেডি রিডিং হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, আহতদের বেশির ভাগের অবস্থা সঙ্কটজনক। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে গুলি করা হয়েছে মাথায়। দেখা দিয়েছে রক্তের সঙ্কট।
আহতদের বাঁচিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি টুইটারে বলেছেন, এমন নৃশংসতার বিষয়ে নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। এ হামলায় যারা নিহত হয়েছে তাদের বেশির ভাগই নিরপরাধ। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এ হামলার কড়া নিন্দা জানিয়েছেন। ওদিকে আগামীকাল সারা দেশে যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ চেয়ারম্যান ইমরান খান তা স্থগিত করেছেন তিনি।
মালালা, সত্যার্থীর হৃদয় ভেঙে গেছে
পেশোয়ারে স্কুলে তালেবানদের নারকীয় হামলায় হৃদয় ভেঙে গেছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই ও ভারতের কৈলাস সত্যার্থীর। এ হামলাকে হৃদয়বিদারক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক বিবৃতিতে মালালা বলেছেন, এই রকম বিবেকহীনের মতো ঘটনায় আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। পেশোয়ারে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়। কৈলাস সত্যার্থী বলেছেন, ওইসব সন্তান আমার। আমার জীবন নিয়ে হলেও ওদের ফেরত দাও।
বিভিন্ন মিডিয়ায় গতকাল তাদের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এতে মালালা বলেন, ওই স্কুলের নিরপরাধ শিশুদের জন্য এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর কোন কারণ নেই। এই নৃশংসতায় আমি নিন্দা জানাই। এটা কাপুরুষোচিত কাজ। আমি এই ভয়াবহ ঘটনায় পাকিস্তানের সরকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে একমত পোষণ করছি। নিহত শিশু, যারা আমার ভাইবোন তাদের মৃত্যুতে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে আমি শোকস্তব্ধ। তাই বলে আমরা পরাজিত হবো না। ওদিকে কৈলাস সত্যার্থী তার বিবৃতিতে বলেন, আমি তালেবানদের কাছে ভিক্ষা চাই। আমাকে নিয়ে এসব শিশুকে মুক্তি দাও। আমার জীবদ্দশায় দেখা এটাই সবচেয়ে শোকাহত ঘটনা। এই শিশুরা আমার সন্তান।

No comments

Powered by Blogger.