মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পদ বিক্রির চিন্তা

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের ২৯টির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দুটিতেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। একটি রয়েছে লাভজনক অবস্থানে। প্রতিমাসে বিপুল পরিমাণ ঘাটতির বোঝা টানতে গিয়ে চরম অর্থ সংকটে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। দীর্ঘদিনের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতাসীনদের ছোবল ও অনিয়মের কারণে সংস্থাটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
এ অবস্থায় সংস্থাটির সব সম্পদ বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিক্রীত সম্পদের টাকা স্থায়ী আমনত (ফিক্সড ডিপোজিট) করে লভ্যাংশের অর্থ দিয়ে ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তাবনা তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজোম্মেল হক এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, বিগত দিনের তথ্য-উপাত্ত ঘেটে দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদ লুট হয়েছে। হাজার কোটি টাকার সম্পদ পানির দরে বিক্রি করা হয়েছে। যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের ছত্রচ্ছায়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদ দখল হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান লাভজনক করা দুরূহ। তিনি বলেন, সম্পদ রক্ষায় আমার সামনে তিনটি পথ খোলা আছে। প্রথমত : সব সম্পদ বিক্রি করে পাওয়া টাকা স্থায়ী আমানত করা, দ্বিতীয়ত : আবাসন করে বিক্রি করা এবং তৃতীয়ত : জমি-জমা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা। আবাসন ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অতীত রেকর্ড ভালো নয়। তাই বিক্রির বিষয়টি নিয়ে সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তদারকির অভাবে ইতিমধ্যে বেশ কিছু সম্পদ বেহাত হয়ে গেছে। জমি-জমা ভোগ-দখল করছে অবৈধ দখলদাররা। প্রতিটি সরকারের আমলে সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পদের ওপর হামলে পড়ে। ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই বড় বড় কোম্পানির কাছে নামমাত্র দামে জমি তুলে দিয়েছেন। এ কারণে সংস্থাটি ধীরে ধীরে রুগ্ন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চারটি প্রকল্প নেয়া হলেও কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় ৭ হাজার ৮৩৮ জনকে সম্মানী ভাতা দেয়া হয়। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা চার ক্যাটাগরিতে মাসে ৯ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এবং মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ১৫ হাজার টাকা, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ পরিবার ২৮ হাজার টাকা ও তারামন বিবি বীর প্রতীক ১৫ হাজার টাকা হারে সম্মানী ভাতাসহ নির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সংস্থাটির কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও অব্যবস্থাপনা ও অর্থ সংকটের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, আবাসন ও বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেয়াসহ নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছে না সংস্থাটি।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৯ সালে কল্যাণ ট্রাস্ট সবচেয়ে বেশি সংকটে ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়ায় ওই অবস্থা কিছুটা কাটতে শুরু করেছে। বেদখল অনেক জমির দলিলাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। খাজনা হালনাগাদ করা হয়েছে। তবে ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় অর্থ সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের মুনাফা ভেঙে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, প্রতি মাসে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের খরচ প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা। অথচ আয় ৫০ লাখেরও কম। ফলে প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। যা বিভিন্ন উৎস্য থেকে মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সংস্থাটির নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ১৮টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে। পরে ১৯৭৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ট্রাস্টকে আরও ১১টি প্রতিষ্ঠান দেন। আর কল্যাণ ট্রাস্ট নিজেই তিনটি প্রতিষ্ঠান (চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ফলের রস কারখানা, ঢাকায় ট্রাস্ট হাসপাতাল ও দুর্বার অ্যাডভারটাইজিং) গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এই ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সচল রয়েছে তিনটি। ১৫টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ৭টি প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। বাকি ৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সচল তিনটি প্রতিষ্ঠানের একটি মিমি চকলেট লিমিটেড। রাজধানীর ২৫৫, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ১ একর জমিতে গড়ে তোলা এ প্রতিষ্ঠানের মাসিক গড় বিক্রি প্রায় ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় চলে যায় প্রায় ৫ লাখ টাকা। চকলেটের কাঁচামাল ক্রয়সহ অন্যান্য খরচ তুলতে পারে না প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেছে, প্রায় ৫০ বছরের পুরনো মেশিনারিজ দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। প্যাকেজিংসহ উৎপাদন প্রক্রিয়া অটোমেটিক না হওয়ায় দেশী-বিদেশী চকলেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। প্রায়শ মেশিনারিতে সমস্যা দেখা দেয়। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ তৈরি বা মেরামত করে উৎপাদন চালিয়ে রাখা হচ্ছে। একই অবস্থায় আরেক লোকসানি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের ইসিআই লিমিটেডের। প্রায় ২৬ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানে রাসায়নিকসামগ্রী ফরমালিন, ইউরিয়া, ফরমালডিহাইড অ্যাডহেসিভ, ইউরিয়া ফরমালডিহাইভ কম্পাউন্ড ও থার্মোসেটিং মোলডিং আর্টিক্যাল উৎপাদন করে। এ প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ ৫০ বছরের পুরনো। বিক্রীত পণ্যের দামও বেশি। এ কারণে প্রতিযোগীতায় বাজারে টিকতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটির মাসে গড় বিক্রি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৮ লাখ টাকা চলে যায় মাসিক বেতন-ভাতায়।
সূত্র জানায়, একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রাজধানীর টয়েনবি সার্কুলার রোডের পূর্ণিমা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিস স্টেশন। এটির মাসে গড় বিক্রি এক কোটি টাকা। বেতন-ভাতায় যায় তিন লাখ টাকা। মাসে এ প্রতিষ্ঠান থেকে ৫-৭ লাখ টাকা লাভ পেয়ে থাকে সংস্থাটি।
সূত্র আরও জানায়, বন্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। বিক্রি করা হয়েছে জমিও । এ তালিকায় রয়েছে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত সিরকো সোপ অ্যান্ড ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ, গুলিস্তান সিনেমা কোম্পানি, বাংলাদেশ গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ (হাইসন্স), যাত্রিক পাবলিকেশন্স, ওমর সন্স (স্ট্রাকচার) লিমিটেড, বেঙ্গল ন্যাশনাল ট্যানারি, ন্যাশনাল ট্যানারি ও মদিনা ট্যানারি, চট্টগ্রামের বাক্সলী পেইন্টস লিমিটেড, হামিদিয়া অয়েল মিলস, হামিদিয়া মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও যাত্রিক পাবলিকেশন্স।

No comments

Powered by Blogger.