সার্ককে অর্থবহ করতে যা প্রয়োজন by ইকতেদার আহমেদ

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকরা ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে বাংলার শাসনক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে তাদের শাসনের সূচনা করলেও সমগ্র ভারতবর্ষ তাদের দখলে আনতে ১০০ বছর লেগে যায়। ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকাবস্থায় অখণ্ড ভারতবর্ষের নাগরিকরা কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে যেতে পারতেন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমনের আগে প্রায় ৬০০ বছর ধরে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে এ অঞ্চল মুসলিম শাসকরা শাসন করেন। এসব মুসলিম শাসক এ অঞ্চলে ভারতবর্ষের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন। ভারতবর্ষ মুসলিম শাসনাধীন থাকাবস্থায় এ অঞ্চলের মানুষের এক স্থান
থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা-নিষেধ ছিল না। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ও মুসলিম শাসনের আগে এ অঞ্চল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজারা শাসন করেন; তবে তাদের শাসনামলে এককভাবে কোনো
রাজা সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হননি।
ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার সময় দেশটির অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন করে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলকে স্বাধীনতা প্রদান করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা- এ তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার কিছুকাল পর থেকে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের অপর স্বাধীন রাষ্ট্রে ভ্রমণের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপিত হয় এবং এর ফলে এ অঞ্চলের এক রাষ্ট্রের নাগরিকদের অপর রাষ্ট্র ভ্রমণে ভিসা গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দেয়, যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।
১৯৮৫ সালে সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রাকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সাতটি রাষ্ট্র- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ এ সংস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কের অন্তর্ভুক্ত হয়। সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ দ্বীপরাষ্ট্র। অপরদিকে নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র।
সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় সার্কের জন্ম দেখে যেতে পারেননি। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান দূরদর্শী ছিলেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে, আমাদের এ অঞ্চলেরও তেমন উন্নয়ন সম্ভব, যদি এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করে তা কাক্সিক্ষত স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়।
আঞ্চলিক জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বর্তমানে বিশ্বের যেসব অঞ্চল সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তার মধ্যে অন্যতম ইইউ, আসিয়ান ইত্যাদি। এসব আঞ্চলিক জোটভুক্ত রাষ্ট্রের নাগরিকদের জোটের অন্তর্ভুক্ত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে ভিসার প্রয়োজন হয় না। এসব অঞ্চলের নাগরিকরা নিজ নিজ অঞ্চলে বাধাহীনভাবে সড়ক, রেল, নৌ বা আকাশ পথে এক দেশ থেকে অপর দেশে যেতে পারেন। এমনকি এসব অঞ্চলের একজন নাগরিক ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও এক দেশ থেকে অপর দেশে ভ্রমণ করতে পারেন। এসব অঞ্চলভিত্তিক জোট নিজ নিজ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য আঞ্চলিক বাণিজ্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এসব অঞ্চলের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে।
সার্ক প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করা। কিন্তু সার্ক প্রতিষ্ঠার পর ৩০ বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখনও সে লক্ষ্য অর্জনে অনেক পথ পাড়ি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
সার্কের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারত আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ। ভারতের পরের অবস্থান পাকিস্তানের। সার্ক প্রতিষ্ঠার আগে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালে সর্বশেষ যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
সার্ক অঞ্চলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশি বসবাস করে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। এ অঞ্চলের শিল্পোন্নয়ন আশাব্যঞ্জক হলেও এক্ষেত্রে আরও উন্নয়নের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিধি এখনও সীমিত। এ পরিধিকে বিস্তৃত করা গেলে সার্কভুক্ত দেশগুলো নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থেকেই অভূতপূর্ব উন্নয়নে সক্ষম হবে।
সার্ক প্রতিষ্ঠার পর যদিও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল, এক দেশের নাগরিকরা বিনা ভিসায় অপর দেশ ভ্রমণ করতে পারবে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়াসহ এক দেশ অপর দেশকে প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করবে; কিন্তু সে লক্ষ্য অদ্যাবধি অর্জন করা যায়নি। নিকট ভবিষ্যতে যে তা অর্জন করা যাবে, এমন আশা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনাও খুব একটা উজ্জ্বল নয়।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ও ভুটান পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। এ দুটি রাষ্ট্র উত্তর দিক থেকে চীন দ্বারা বেষ্টিত হলেও সেদিকের সম্পূর্ণ সীমানা দুর্গম পাহাড়ি পথের অন্তর্ভুক্ত। তাই সেদিক দিয়ে যোগাযোগ বলতে গেলে অনেকটাই দুর্ভেদ্য। নেপাল ও ভুটান বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভারতরে ওপর নির্ভরশীল। এ দুটি দেশ দীর্ঘদিন ধরে সার্কের আঞ্চলিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারত হয়ে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের দাবি করে এলেও তা বাস্তবায়নে ধীরগতি সার্কের চেতনাকে মলিন করে দিচ্ছে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। এ রাজ্যগুলো অপর রাষ্ট্রের স্থলভাগ দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় চিকেন নেক করিডোর নামক একটি সরু পথ দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এ পথ দিয়ে যোগাযোগ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এ সাত রাজ্যের সঙ্গে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিট স্থাপনে আগ্রহী। নৌপথে ট্রানজিটটি চালু থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় নদীর নাব্য স্বল্প হওয়ায় তা বছরব্যাপী ফলদায়ক নয়। অপরদিকে সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট দিতে গেলে যে অবকাঠামোর প্রয়োজন, তা বাংলাদেশ এখনও গড়ে তুলতে পারেনি।
ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদী বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এ নদীগুলোর অধিকাংশ থেকে একতরফাভাবে উজানে ভারত পানি প্রত্যাহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কৃষিতে সেচের কাজসহ অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর নাব্যতা রক্ষায় কাজে লাগাচ্ছে। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। সার্কের চেতনা কখনও এক প্রতিবেশী রাষ্ট্র কর্তৃক অপর প্রতিবেশীর জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি অনুমোদন করে না।
ভারতের তুলনায় সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হওয়ায় সার্কের চেতনাকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে ভারত সব সময় সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি বড় ভাইসুলভ আচরণ দেখিয়ে এসেছে। ভারতের এ আচরণের কারণে সার্ক একদিকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে, অপরদিকে সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও হচ্ছে বিপন্ন।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ থাকলেও ট্রানজিট সুবিধা না থাকায় ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। এ তিনটি দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রেও ভিসার আবশ্যকতা থাকায় যোগাযোগ খুব একটা সহজসাধ্য নয়। একজন ভারতীয় নাগরিকের জন্য বাংলদেশ ও পাকিস্তানের ভিসা নিয়ে এ দুটি দেশ ভ্রমণ যতটুকু সহজসাধ্য, এ দুটি দেশের নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ভিসা নিয়ে সে দেশ ভ্রমণ ততটুকু সহজসাধ্য নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের যে বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে, ট্রানজিটের অনুপস্থিতিতে তা ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এতে করে উভয় রাষ্ট্রের আমদানি ও রফতানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে অন্যান্য আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান যোগাযোগই নয়; এক দেশের মধ্য দিয়ে অপর দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেল সরবরাহ করা হচ্ছে, এক দেশের মুদ্রা অপর দেশে বিনিময়যোগ্য অথবা জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং একই সিম কার্ড ব্যবহার করে স্বল্প খরচে জোটভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকরা অতি সহজে অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারেন।
ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান। পাশাপাশি উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিও বিকাশমান। আঞ্চলিক সহযোগিতার পরিধির আওতায় যদি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়া যায়, ভিসা প্রথার বিলোপ সাধন করা যায়, এক দেশের মুদ্রা অপর দেশে সহজে বিনিময়যোগ্য করা যায় অথবা অভিন্ন মুদ্রা চালু করা যায়, ব্যক্তিগত গাড়িযোগে এক দেশ থেকে অপর দেশ ভ্রমণের সুবিধা চালু করা যায়, এক দেশ থেকে অপর দেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেল ও পানির প্রবাহ সহজলভ্য করা যায়, একই সিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজে ও স্বল্প খরচে ফোনে কথা বলা যায় এবং বাণিজ্যের পরিধি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করা যায়; তাহলেই সার্ক অন্যান্য আঞ্চলিক জোটের মতো সমৃদ্ধ জোটে পরিণত হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের প্রতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি প্রদর্শন এবং সুযোগ ও সহযোগিতার সর্বোত্তম ব্যবহার।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.