বাংলাদেশের এক বিপজ্জনক সংকট প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোর এমনই দুরবস্থা যে, এদের নেতানেত্রীদের কারও মুখে কোনো লাগাম নেই। লাগাম তাদের মুখেই থাকে না যারা দায়িত্বজ্ঞানহীন। এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই এখন পরিণত হয়েছে এখানকার এই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যে। এসব লাগামহীন কথাবার্তার কোনো উদাহরণ দেয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ এর সঙ্গে জনগণের পরিচয় আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই আচরণের উল্লেখ না করে উপায় নেই। কারণ দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও তা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় কাজ করে তার মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে আরও বিশেষভাবে একথা বলা দরকার এ কারণে যে, এই দলগুলোর নেতৃত্বই শুধু নয়, তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও লেখকরা এর ক্ষতিকর দিক কিছুটা সামাল দেয়ার পরিবর্তে এর অবনতি ঘটানোর ক্ষেত্রে বড় রকম অবদান রাখেন। তাদের জো-হুজুরগিরি মানসিকতা এবং মেরুদণ্ডহীনতার কারণেই তাদের এই অবস্থা। একটা জাতির জীবনে এর থেকে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর ব্যাপার আর কী হতে পারে?
এ বিষয়টির উল্লেখই যথেষ্ট নয়। এর কারণ অনুসন্ধানও এক আবশ্যিক কর্তব্য। কী কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির এই অবনতি ঘটল, সে বিষয়ে অন্ধকারে থাকলে অথবা বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে শুধু এর সমালোচনা করলে তার দ্বারা কিছুই হওয়ার নয়। প্রথমত বলা দরকার যে, বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে নব্য শাসকশ্রেণীর জন্ম ও বিকাশ কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ যেভাবে স্বাধীন হয়েছিল, তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কারও কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ও করণীয় বিষয়ে বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। একথা বললে নিশ্চয়ই কোনো দেশদ্রোহিতা হবে না যে, হঠাৎ করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বাংলাদেশ অবশ্যই স্বাধীন হতো, কারণ এই স্বাধীনতার মূল শর্ত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান যেভাবে দুই অংশে বিভক্ত হয়ে গঠিত হয়েছিল তার মধ্যেই নিহিত ছিল। সে কারণে একেবারে প্রথম থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে তার অপরিহার্য পরিণতি ছিল এই অঞ্চল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হওয়া। সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রসর হয়ে গঠিত হতে থাকা মধ্য শ্রেণীকে একটি স্বাধীন দেশ পরিচালনার উপযুক্ত করার আগেই আমাদের জনগণের ওপর পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই অঞ্চল অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কারণে যাদের হাতে দেশ পরিচালনার ভার পড়েছিল, তারা স্বাধীন বাংলাদেশে অল্পদিনের মধ্যেই সৃষ্টি করেছিল এক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি। লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, প্রতারণা এবং এসবের প্রয়োজনে ব্যাপক সন্ত্রাসের মধ্যে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াই তৎকালীন শাসক দলই শুধু নয়, সমগ্র শাসক শ্রেণীর চরিত্র গঠন করেছিল। এ কারণে শুধু আওয়ামী লীগই নয়; বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও চারিত্রিক দিক দিয়ে মূলগতভাবে লাভ করেছিল এক অভিন্ন চরিত্র। তাদের এই অভিন্ন চরিত্রের কারণেই শাসনক্ষমতায় থাকার সময় তাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য দেখা যায় না। তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের শোচনীয় অবস্থা এবং তাদের মধ্যে সততার অভাব এই পরিস্থিতির সঙ্গেই সম্পর্কিত।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ এখানে অবশ্যই করা দরকার। যে কোনো দেশের শাসক শ্রেণীই শিক্ষাব্যবস্থাকে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের অধীন রাখে। সুগঠিত পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক অথবা অসংগঠিত ও অপরিপক্ব যাই হোক, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীও তাদের চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিযুক্ত হয়েছিল। এ কাজ করতে গিয়ে তারা সব থেকে সর্বনাশা যে কাজটি করেছিল তা হল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইতিহাসকে পাঠ্য বিষয় হিসেবে উঠিয়ে দেয়া। এদিক দিয়ে বাংলাদেশই দুনিয়ার একমাত্র দেশ। এক্ষেত্রে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, ইতিহাস চর্চা এভাবে উঠিয়ে দেয়া সত্ত্বেও ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে এদের থেকে বেশি বাগাড়ম্বর অন্য কোনো দেশে নেই! নিজেদের দেশের ইতিহাস বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকা দুই প্রজন্মের ইতিহাস এবং সত্য অর্থে ইতিহাস বিকৃতকরণ কাকে বলে, তার কোনো ধারণাই প্রকৃতপক্ষে নেই। ইতিহাসের সঙ্গেই যাদের পরিচয় নেই, ইতিহাসের সত্যাসত্য যাচাই করার ক্ষমতা তাদের না থাকাই স্বাভাবিক। ইতিহাস বলতে এখানে শুধু বোঝায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের তথ্য নিয়েই এখানে যত ঝগড়া-বিবাদ এবং ঝগড়া-বিবাদের নামই হল ইতিহাস চর্চা!! যাই হোক, এখানে সাধারণ ইতিহাস চর্চা শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বাদ দেয়ার ফলে এই জাতির নতুন প্রজন্ম নিজেদের অতীত সম্পর্কে অন্ধকারেই আছে। আগে একজন ম্যাট্রিক পাস করা ছাত্রের সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাচীন, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের ইতিহাসের যে পরিচয় হতো, তার কোনো কিছুই আর নেই। এর থেকে বড় ট্রাজেডি একটা জাতির জীবনে আর কিছু হতে পারে না। কারণ এর ফলে শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা যে অধরা থেকে যাচ্ছে তাই নয়, সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে নিয়ে সচেতন জনগণ নিজেদের ইতিহাস বা অতীত না জানার কারণে বর্তমানকে সঠিকভাবে জানার ও বোঝার কোনো ব্যাপারও নেই। তারা নিজেদের বর্তমান অবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ করতে অক্ষম এবং অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের কারণে সঠিকভাবে ভবিষ্যৎ চিন্তাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি এদেশের জনগণের ও নতুন প্রজন্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু অর্জন সত্ত্বেও চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং সমাজবিরোধী মানসিকতার প্রাধান্য ঘটিয়েছে। ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান বলেও এদের কিছু নেই। পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞানের অভাব যে কীভাবে এখানে সমগ্র শাসক শ্রেণীর মধ্যে, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের মধ্যে, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে চিন্তাগত ও আচরণগত নৈরাজ্য ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এ বিষয়ে কিছু ব্যতিক্রমী লোক ছাড়া অন্য কারও ধারণা নেই। কাজেই এটা তাদের কাছে কোনো সমস্যা নয়!! সমস্যা না হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোনো প্রচেষ্টাও তাদের কারও মধ্যে নেই।
কোনো জাতির চরিত্র, অভ্যাস, আচরণ, চিন্তাভাবনা আকাশ থেকে পড়ে না। তাদের আর্থিক ও সামাজিক জীবনের মধ্যে, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই তার মূল নিহিত থাকে। কাজেই বর্তমানে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন দলের মধ্যে, বিশেষ করে প্রথম শাসক দল ও বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসক দলের নেতানেত্রীদের মধ্যে সুসংস্কৃতি, শালীনতা ও ভদ্রতা ইত্যাদির প্রকট অভাব এবং যে অশ্লীলতা তাদের আচরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। তার কারণ অনুসন্ধান এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। এ দায়িত্ব বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.