উৎপাদন বাড়লেও পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক -গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা

(প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত ‘গরিববান্ধব কৃষি ব্যবসা: সম্ভাবনা ও সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো) কৃষিতে উৎপাদন বাড়লেও কৃষক এখনো পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের কাছে কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তি ও তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। পাশাপাশি পণ্য বিপণন ব্যবস্থা উন্নত করে তার সঙ্গে প্রান্তিক কৃষককে সরাসরি যুক্ত ও ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।  প্রথম আলো আয়োজিত ‘গরিববান্ধব কৃষি ব্যবসা: সম্ভাবনা ও সমস্যা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এসব মতামত তুলে ধরেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুইস কন্ট্যাক্টের এগ্রি বিজনেস ট্রেড কম্পিটিটিভনেস প্রকল্প-ক্যাটালিস্টের সহযোগিতায় গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এ গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান আলোচক ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিড (বীজ) উইংয়ের মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক নির্মল চন্দ্র ভক্ত।
আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষক যেন তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পান সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। সে জন্য উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি কৃষক যাতে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় উপকরণটি হাতের কাছে পান সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি। এ জন্য এ খাতের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। তাঁর মতে, চাঁদাবাজি ও আড়তদারদের দৌরাত্মে৵র কারণেও কৃষকেরা পণ্যের যথাযথ দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। কৃষিকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এ খাতের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক নির্মল চন্দ্র ভক্ত বলেন, বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত কর্মসংস্থানের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষি। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৫০ শতাংশই হয়েছে এ খাতে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে বা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি হ্রাস পাচ্ছে। ১০ টাকার হিসাব খোলার মাধ্যমে দেশের এক কোটি প্রান্তিক কৃষককে ব্যাংকিং লেনদেনের আওতায় আনা হয়েছে। এসব হিসাব যাতে সচল থাকে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ২০০ কোটি টাকা পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ূমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের উপসচিব হাফিজুর রহমান, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আমজাদ খান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শেখ মোরশেদ জাহান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ, এসিআই এগ্রি বিজনেসের নির্বাহী পরিচালক এফ এইচ আনসারী, উন্নয়ন সংস্থা সুইসকন্ট্যাক্টের কর্মকর্তা অনির্বাণ ভৌমিক, ক্যাটালিস্টের ক্যাপিটালাইজেশন, কমিউনিকেশনস ও এক্সটারনাল রিলেশনস বিভাগের প্রধান নাসিরউদ্দিন আহমেদ, এম এম ইস্পাহানি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক ফওজিয়া ইয়াসমীন, পেট্রোকেম বাংলাদেশের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক পার্থ সারথী রায়, লালতীর সিড লিমিটেডের নির্বাহী সমন্বয়ক ফিরোজ শাহ শিকদার।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের সিইও আমজাদ খান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে কৃষিনির্ভর ব্যবসা একটি লাভজনক ব্যবসা। অন্যান্য ব্যবসার মতো এ ব্যবসায়ও অনেক সমস্যা রয়েছে। তাই সাহস করেই এ ব্যবসায় নামতে হবে। দেশের সত্যিকার উন্নয়ন ঘটাতে হলে সেটি কৃষির মাধ্যমেই ঘটাতে হবে। তাঁর বক্তব্যে তিনি জানান, বর্তমানে দেশের প্রায় ৭৮ হাজার কৃষক প্রাণ আরএফএল গ্রুপের বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের উপসচিব হাফিজুর রহমান বলেন, বিদেশের বাজারে রপ্তানির সময় আন্তর্জাতিক মানে মোড়কজাত করা হয় না বলে আমাদের শাকসবজি, ফলমূলসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এমনকি রপ্তানি প্রক্রিয়ার নানা ধাপে পণ্য নষ্ট হয়। এর ফলে দামের দিক থেকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় হারায় আমাদের পণ্য।
ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শেখ মোরশেদ জাহান বলেন, কৃষিপণ্যের ফলন পরবর্তী অব্যবস্থাপনার কারণেই শুধু কৃষকের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ লোকসান হয়। আমাদের দেশে পণ্য উৎপাদনে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় উৎপাদন-পরবর্তী সংরক্ষণের বেলায় ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, কৃষির উন্নয়নের পরিকল্পনা এমনভাবে হওয়া উচিত যার ফলে কৃষক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত যেন সুফল পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
ক্যাটালিস্টের ক্যাপিটালাইজেশন, কমিউনিকেশন ও এক্সটারনাল রিলেশনসের প্রধান নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, কৃষি ব্যবসাটি কীভাবে আরও বেশি দরিদ্র কৃষক ও ভোক্তাবান্ধব করা যায়, তা গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বের করা দরকার।
সুইসকন্ট্যাক্টের অনির্বাণ ভৌমিক বলেন, বাংলাদেশের কৃষককে এখন শুধু একজন কৃষক বা উৎপাদক হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। একেকজন কৃষক মানেই এখন একেকজন উদ্যোক্তা। তাই অন্যান্য ব্যবসার মতো এ খাতের উন্নয়নে কৃষকের ঋণপ্রাপ্তিকে সহজলভ্য করতে হবে।
ইস্পাহানি গ্রুপের ফওজিয়া ইয়াসমীন বলেন, বাংলাদেশের সব ব্যবসা সূচনা পর্বে সরকারি অর্থ সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু কৃষি ব্যবসার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো সহযোগিতা মিলছে না। ফলে এ খাতের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্য সংরক্ষণাগারসহ নানা ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। যার সর্বশেষ প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্যের দামের ওপর।
এসিআইয়ের এফ এইচ আনসারী বলেন, কৃষি ব্যবসার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি। বড় কৃষকেরা প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি করতে পারলেও ছোট কৃষকেরা তা পারছেন না। ফলে বাজার প্রতিযোগিতায় ছোট কৃষকদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই প্রান্তিক কৃষকের কাছেও যাতে প্রযুক্তি ও তথ্যসেবা সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে।
লালতীর সিডের ফিরোজ শাহ শিকদার বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতি বা কৃষকের জন্য সবার আগে প্রয়োজন পুঁজি। কৃষকের পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে কৃষি বাণিজ্য সহায়তা তহবিল নামে বিশেষ তহবিল গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
পেট্রোকেম বাংলাদেশের পার্থ সারথী রায় বলেন, কৃষকের কাছে পণ্যের দাম বড় কোনো বিষয় নয়। কৃষক চান মানসম্মত কৃষি উপকরণ, যা দিয়ে তাঁরা উৎপাদন বাড়াতে পারবেন। কৃষকের সেই চাহিদা পূরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

No comments

Powered by Blogger.