রাজশাহীতে গ্রিসের ‘লেমনি’ by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

(গাছে ধরে আছে কাঁচা ‘লেমনি’। চারঘাটের ফতেপুর গ্রামে বেলাল হোসেনের বাড়িতে। ডানে পাকা লেমনি l ছবি: প্রথম আলো) গ্রামের নাম পার্নাসোস। গ্রিসের রাজধানী এথেন্স থেকে ২৮৫ কিলোমিটার উত্তরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়ি গ্রামটিতে প্রচণ্ড ঠান্ডা। সুদূর গ্রিসের এই গ্রামেই বাংলাদেশি বেলাল হোসেনের চোখে পড়ে একটি ফল। স্থানীয় লোকদের কাছে যা ‘লেমনি’ নামে পরিচিত। স্বাদ ও গন্ধে লেমনি আমাদের দেশীয় কাগজিলেবুর মতোই। কিন্তু আকারে অনেক বড়; রসও বেশি। বেলালের হাত ধরে এ দেশে আসার পর এখন লেমনির চাষ হচ্ছে রাজশাহীতে। শুধু তাই নয়, রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রে লেমনি নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে। অচিরেই লেবুর নতুন জাত হিসেবে ছাড়া হতে পারে লেমনিকে। বর্তমানে এটি রয়েছে মূল্যায়ন পর্যায়ে। ২০০৫ সালের কথা। সপরিবারে গ্রিস ছাড়ছিলেন বেলাল। তখনো তাঁর মাথায় ছিল লেমনি। তাই দেশে ফেরার সময় বেলাল পার্নাসোস গ্রামে গেলেন। লেমনির একটি চারা সংগ্রহ করলেন। দেশে ফিরে তিনি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ফতেপুর গ্রামে নিজের বাগানে চারাটি রোপণ করেন। তখন এর উচ্চতা ছিল এক ফুটের মতো।
বেলাল জানালেন, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় গাছটাকে টিকিয়ে রাখতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কারণ, পার্নাসোস গ্রামে ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা। আর এখানে গরম। তিনি গাছটির ওপর খড়ের চালা তৈরি করেন। তিন বেলা চট ভিজিয়ে চারদিকে ঘিরে দিতেন। একটা পর্যায়ে মরতে মরতে গাছটি বেঁচে যায়। এক বছরের মাথায় সেটি আগের চেহারা ফিরে পায়। ফল আসে দুই বছরের মাথায়। সেই গাছ থেকে কলম তৈরি করে ছয়টি রোপণ করেন রাজশাহী শহরে নিজ বাড়ির ছাদের টবে। আরও তিনটি দেন রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রকে।
বেলালের গ্রামের বাড়ির গাছটি ১৪-১৫ ফুট উঁচু হয়েছে। এখন প্রায় এক হাজার লেবু আসে। আর টবের গাছে ধরে ২০-২৫টি করে। অবশ্য এ বছর ব্যস্ততার কারণে গাছের ভালো যত্ন নিতে পারেননি। তাই ফলনও বেশি ভালো হয়নি। গত বছর রোজার মাসে প্রতিটি লেবু পাইকারদের কাছে ১০ টাকা করে বিক্রি করেছেন বেলাল। আর খুচরা বিক্রেতারা বাজারে ১৫-২০ টাকা করে বিক্রি করেছেন।
ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, লেমনির আদিনিবাস চীনে। সেখান থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে। সে দেশের কৃষি দপ্তরের কর্মী ফ্রাঙ্ক নিকোলাস মায়ার চীন সফরের সময় নমুনা হিসেবে নিজ দেশে নিয়ে যান একটি চারা। সম্ভবত তাঁর নামানুসারেই এর ইংরেজি নাম meyer lemon. বৈজ্ঞানিক নাম citrus limon. এটি rutaceae পরিবারের একটি ফল।
একটি প্রমাণ আকারের লেমনির দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার; প্রস্থ্য ৬ দশমিক ২ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ১৪৮ গ্রাম। এই আকৃতির একটা লেমনি থেকে রস পাওয়া যায় ১০০ মিলিলিটার। বড় আকারের হলে ২০০ গ্রাম পর্যন্তও রস পাওয়া যায়। এ বছরের লেমনিতে প্রতি ১০০ গ্রামে ভিটামিন সি পাওয়া গেছে ২৯ দশমিক ৩৮ মিলিগ্রাম। এতে মোট চিনি রয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর অম্লতার পরিমাণ ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
লেমনিগাছে ফুল আসে ফেব্রুয়ারিতে। নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত গাছে থাকে। পরিপক্ব হলে গায়ের রং হলুদ হয়ে যায়।
রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দীন বলেন, তাঁরা গবেষণা করে লেমনির দুটি সম্ভাবনার দিক দেখতে পেয়েছেন। একটি হচ্ছে, এটি আকারে দেশীয় লেবুর চেয়ে অনেক বড়। এতে প্রচুর পরিমাণে রস আছে। ভিটামিন সির পরিমাণও বেশি। অন্যটি হচ্ছে, দেশীয় লেবুর মৌসুম যখন শেষ হয়, তখন লেমনি উঠতে শুরু করে। অসময়ে হওয়ার কারণে লেমনি ভালো বাজার পাবে।

No comments

Powered by Blogger.