আমেরিকায় কি আদৌ বর্ণসাম্য আসবে?

ছয় বছর আগে আমেরিকায় যখন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা নির্বাচিত হলেন, তখন সমাজবিজ্ঞানীরা বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্ণবাদ-উত্তর সমাজব্যবস্থায় প্রবেশ করল। ওবামার বিদায়ের মুহূর্ত এখন ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু আমেরিকা বা এর সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন আসলে কতটুকু হয়েছে? ফার্গুসন নিউইয়র্কের পর অ্যারিমোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বর্ণবাদপ্রথা মার্কিনিদের শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত। এ অবস্থা থেকে বের হওয়া আদৌ সম্ভব কিনা কিংবা আদৌ কি সেখানে বর্ণসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে?
তা এখন নতুন করে ভাববার সময় হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার তিনজন কেবিনেট সদস্য কৃষ্ণাঙ্গ। এর মধ্যে আছেন বিদায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার, হোল্ডারের উত্তরসূরি হিসেবে ওবামা মনোনীত লরেত্তা লিঞ্চ। লরেত্তার নিয়োগ কার্যকর হলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রধান।
মোটা দাগের এই চমকপ্রদ তথ্য বাইরে রেখে ভেতরে নজর দিলে বোঝা যাবে আসল রহস্য। যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনগোষ্ঠীর ১৪ শতাংশ আফ্রো-আমেরিকান বা কৃষ্ণাঙ্গ। দেশটির সংবিধানে নাগরিক অধিকার অধ্যাদেশ সংযুক্ত হওয়ার ৫০ বছর পর এখানকার ১০০ সিনেটরের মধ্যে মাত্র দুজন কৃষ্ণাঙ্গ। কোম্পানিগুলোর কথা বললে ৫০০টির মধ্যে ১০ জন কৃষ্ণাঙ্গও কোম্পানির সিইও বা প্রধান নির্বাহী পদে নেই। দেশের পাঁচ শতাধিক কোটিপতির মধ্যে মাত্র দুজন অপরাহ উইনফ্রে ও মাইকেল জর্ডান।
ন্যাশনাল পোভার্টি সেন্টারের ২০১০ সালের তথ্যানুযায়ী কৃষ্ণাঙ্গদের ২৭.৪ শতাংশ জনগণ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। এই পরিসংখ্যান অহিস্পানিক শ্বেতাঙ্গদের মাত্র ৯.৯ শতাংশ। গত বছরের পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা মতে, শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অন্তত ৬ গুণ কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিত্বের শিকার। আর যে কারণে আমেরিকা এখন উত্তাল, তা তো হরহামেশাই ঘটছে- শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গর মৃত্যু। প্রো-পাবলিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১০-১২ সাল পর্যন্ত ১৫-১৯ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরদের মিলিয়ন প্রতি ৩১.১৭ শতাংশ পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে, যা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অন্তত ২০ গুণ বেশি।
নির্বাচনী প্রচারণায় ওবামা বলেছিলেন, আমেরিকা থেকে বর্ণবাদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বর্ণবাদ-উত্তর সমাজব্যবস্থার প্রচলন ঘটতে যাচ্ছে তার হাতে। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগে ফার্গুসনে ব্যাপক বর্ণবাদী দাঙ্গার পর তিনি হতাশ হয়ে জানিয়েছেন, কঠিন সত্য হচ্ছে, বর্ণবাদ সমাজের অনেক গভীরে প্রোথিত। এটা ফার্গুসনের সমস্যা নয়, এটা আমেরিকান সমস্যা।
ফার্গুসনে দাঙ্গার সময়, একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিস (৩৪) তার পূর্ণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কৃষ্ণাঙ্গ যুবকরা সত্যিকারভাবে জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পায় না। তাদের জীবনের যেখানে মূল্য নেই, সেখানে তারাও গুলি করলে, বিল্ডিং ভাংচুর করলে, দাঙ্গা, লুটপাট করলে কী আর এসে যাবে! ভিডিও দৃশ্যে স্পষ্ট বোঝা যাওয়ার পরও কৃষ্ণাঙ্গ এরিক বার্গারকে শ্বাসরোধে হত্যাকারী শ্বেতাঙ্গ পুলিশকে দায়মুক্তি দিয়েছে নিউইয়র্কের গ্রান্ড জুরি। দুই সপ্তাহ আগেই ফার্গুসনে দায়মুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনা লরেত্তা লিঞ্চের বিচার বিভাগীয় প্রধান হওয়ার পথে জটিলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ছয় সন্তানের জনক নিরস্ত্র বার্গারকে (৪৩) হত্যার সময় নাগরিক অধিকার লংঘিত হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড ঘিরে বিক্ষোভ চলছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি'র খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার রাতে বৃষ্টির মধ্যে নিউইয়র্কে শত শত লোক বিক্ষোভ করে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্র্য্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী মাটিতে লাশের মত করে শুয়ে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা ও গ্র্যান্ড জুরির সিদ্ধন্তের প্রতিবাদ জানান। এ ছাড়া মায়ামি, শিকাগো, বোস্টন, নিউ অরলিন্স ও ওয়াশিংটন ডিসিতেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.