বেতন ৯ হাজার ৮শ টাকা খরচ সোয়া ২ লাখ!

ফখরুল আলম ওরফে মানিক। বান্দরবান সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিন্তু বান্দরবানে যান কালেভদ্রে। বসবাস করেন চট্টগ্রাম মহানগরীর অভিজাত আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায়। খাদ্য গুদামের দায়িত্বে থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি আজ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। সবাই তাকে খাদক মানিক হিসেবে চেনেন।
এ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ২০০৭ সালের ১ জুলাই যৌথবাহিনী খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি খাদ্য গুদাম থেকে ঘুষের ৩০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করেছিল। এ ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে আবার চাকরি ফিরে পান তিনি। আবারও শুরু করেন ঘুষ দুর্নীতির মহাযজ্ঞ। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ অভিরামপুর গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান মানিক খাদ্য বিভাগে চাকরির সুবাদে গত দেড় দশকে কোটিপতি বনে গেছেন। জীবনযাপন করেন রাজসিক কায়দায়। বন্দরনগরীর আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে কিনেছেন ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ১০ একর জায়গা। চলাফেরা করেন লেটেস্ট মডেলের প্রিমিও কার নিয়ে। তার ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালনার জন্য রয়েছে আরও দুটি ট্রাক। তিনি যে বাসায় থাকেন তার মাসিক ভাড়া ৩৫ হাজার টাকা। তার এক ছেলে পড়ে রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে, অপর ছেলে নটরডেম কলেজে এবং ছোট মেয়ে পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম সিলভারডেল স্কুলে। তার সরকারি মাসিক বেতন ৯ হাজার ৮শ টাকা হলেও খরচের তালিকা অনেক দীর্ঘ। ট্রাক কেনার কিস্তি বাবদ প্রতিমাসে ১ লাখ টাকা, বাড়িভাড়া প্রতিমাসে ৩৫ হাজার, ড্রাইভারের বেতন ১৪ হাজার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বাবদ ৫০ হাজার, ঠিকাদারি লাইসেন্স পরিচালনার জন্য প্রতিনিধির বেতন ১১ হাজার ও অন্যান্য বাবদ ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। অর্থাৎ তার প্রতিমাসে খরচ সোয়া ২ লাখ টাকার বেশি।
খাদ্য বিভাগের এ দুর্নীতির বরপুত্রের আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের ৩নং শান্তিবাগে রয়েছে ৭ গণ্ডা জমি। কয়েক বছর আগে সালাম মামুন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়ে এ জমিটি কিনেছেন। বর্তমানে জমিটিতে এক তলা বাড়ি রয়েছে। কিন্তু তিনি এ বাড়িতে থাকেন না। থাকেন পাশের সালাম ভ্যালি নামে একটি অভিজাত টাওয়ারে। তার বাড়িসহ জায়গাটির বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। বুধবার শান্তিবাগ ৩নং রোড, রহমানবাগ আবাসিক এলাকা, ছোটপুল উত্তর আগ্রাবাদে গেলে রফিক নামে একজন বাসিন্দা জানান, বাড়িটি সব সময় তালা দেয়া থাকে।
দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তার ১০ একর জায়গা রয়েছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে। তিনি কয়েক বছর আগে আয়াত আলী নামে একজনের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে জায়গাটি কিনেছেন। আয়াত যুগান্তরকে জানান, মানিক স্যার জায়গাটি আমার কাছ থেকে কিনেছিলেন। এখন এর বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা।
খাদ্য বিভাগের ওই কর্মকর্তার রয়েছে একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ফখরুলের স্ত্রী সালেহা আলম, শাশুড়ি খুজিস্তা আক্তার চৌধুরী ও অপরটি পিতা আবুল কালামের নামে। স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স সুহৃদ ইন্টারন্যাশনাল, পিতার নামে কালাম অ্যান্ড সন্স, শাশুড়ি খুজিস্তা আক্তার চৌধুরীর নামে সাজিদ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে আগ্রাবাদে তার বাড়ির ঠিকানা শাস্তিবাগ ৩নং রোড, রহমানবাগ আবাসিক এলাকা, ছোটপুল উত্তর আগ্রাবাদ। অথচ ওই ঠিকানায় কেউ বসবাস করেন না। চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন তার নিকট আত্মীয় আবু নাছেরকে।
চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক (খাদ্য) চট্টগ্রামের তথ্যানুযায়ী, সাজিদ এন্টারপ্রাইজ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিল উত্তোলন করেছে ১৪ লাখ ২১ হাজার টাকা। কালাম অ্যান্ড সন্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিল উত্তোলন করেছে ১৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, তার এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সবাই জানেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে যত বিল হয় তার ২০ শতাংশ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ভাগ দিতে হয়। তার ঠিকাদারি লাইসেন্সের বিল আটকে থাকার নজির নেই। ফখরুল আলমের মেসার্স ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ি নং ৬০৬, রোড নং ২২/২, সিডিএ আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম। শুক্রবার এ ঠিকানায় গিয়ে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি আবু নাছের স্বীকার করেছেন, ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ফখরুল আলম মানিকের। বাড়িটির নিরাপত্তা কর্মকর্তা আজাদ যুগান্তরকে জানান, এ নামে (ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজ) ওই ভবনে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আবু নাছের যুগান্তরকে জানান, ফখরুল স্যার আমাকে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন। আমি শুধু চাকরি করি। তিনি আর বিস্তারিত কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক (খাদ্য) জহিরুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, খাদ্য বিভাগে কর্মরত কেউ ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত থাকা আইনগতভাবে অবৈধ এবং অনৈতিক। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফখরুল আলমের চলাফেরা মন্ত্রণালয়ের কোনো সিনিয়র সচিবের মতো। টাকা খরচ করেন পানির মতো। তার ব্যবহৃত প্রিমিও কারটি কেনা হয়েছে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে। যার নম্বর চট্টমেট্রো গ ১২-৭৩২১। বিআরটিএ থেকে জানা যায়, কারটি নিবন্ধন নেয়া হয়েছে জহিরুল ইসলাম, পিতা ওবাইদুল হক। ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে হাউস নম্বর ১১, রোড নম্বর ৩, লেন নম্বর ৫, ব্লক- কে, রামপুর, হালিশহর। ওই ঠিকানায় থাকেন জহিরুল ইসলাম নামে এক গাড়ি ব্যবসায়ী। জহিরুল মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, কারটি আমার নামে হলেও এটি ব্যবহার করেন ফখরুল আলম মানিক সাহেব। বিস্তারিত কথা বলতে চাইলে নেটওয়ার্ক ডিস্টার্ব বলে ফোন কেটে দেন। পুনরায় কল করলে মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ঠিকাদারী ব্যবসার জন্য ফখরুল আলম কিনেছেন দুটি ট্রাক। একটির নম্বর চট্টমেট্রো ট ১১-৩৯৭১। ট্রাকটি ২০১৩ সালের জুন মাসে ফখরুল আলমের স্ত্রীর সালেহা আক্তারের নামে কেনা। ট্রাকটি কিনেছেন ৩৩ লাখ টাকা দিয়ে। ডাউনপেমেন্ট হিসেবে দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এখন প্রতিমাসে ১ লাখ টাকা করে পেমেন্ট দেয়া হচ্ছে। নিটল মোটরসের নির্বাহী ও এ ট্রাকটির কিস্তি আদায়ে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ যুগান্তরকে জানান, ফখরুল আলম প্রতিমাসে নির্ধারিত ১ লাখ টাকা করে প্রদান করছেন। খাদ্য বিভাগের অপর একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে ফখরুলের আরও একটি ট্রাক আছে।
এ বিষয়ে ফখরুল আলম মানিক বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও গাড়ি-বাড়ি থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমার সম্পর্কে নিউজ করার কিছুই নেই। যা শুনেছেন সবই মিথ্যা। আপনি পারলে নিউজ করেন। তিনি বর্তমানে ঢাকায় আছেন জানিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বাচ্চু নামের একজনকে ফোন ধরিয়ে দেন। বাচ্চু নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদককে এ নিয়ে কোনো নিউজ না করে ব্যক্তিগতভাবে মানিক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। নিউজ করা হলে যুগান্তরের চাকরি খেয়ে ফেলারও হুমকি দেন তিনি। মানিকের স্ত্রী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুহৃদ ইন্টারন্যাশনালের মালিক সালেহা আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ও ট্রাক থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, আপনাকে এসব তথ্য কে দিয়েছে, এসব খবর কোথায় পান? চট্টগ্রাম বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল আজিজ মোল্লা যুগান্তরকে জানান, খাদ্য বিভাগে কর্মরত থাকলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকার কথা নয়। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.