‘৭৫-এ জাসদ জানতো না, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে’

আমি হিসাব করে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর ডেড বডি অনাদরে-অবহেলায় ৩২ ঘণ্টা পড়েছিল ৩২ নম্বর রোডে। সেখানে কোন বীরউত্তম যাননি। একজন পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা জামিল উদ্দিন আহম্মদ যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যাওয়ার পথে তাকে হত্যা করা হয়। আর বীরউত্তমরা তখন সব রেডিও স্টেশনে। জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলেন। জিয়া রীতিমতো লবিং করেছেন ফারুক-রশিদের কাছে টু মেক হিম প্রেসিডেন্ট। তাহের জিয়ার হয়ে লবিং করেছেন জিয়াকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্য। এখন আমরা যদি ফারুক-রশিদের ওই ইন্টারভিউকে ক্রেডিবল ইনফরমেশন মনে করি যে জিয়ার সাথে তারা দেখা করে বলেছিল স্যার কিছু একটা করেন। এই ইনফরমেশন যদি ক্রেডিবল হয়, তাহলে তাহের যে ফারুক-রশিদের কাছে গিয়ে বললো জিয়াকে প্রেসিডেন্ট বানান- সে ইনফরমেশন আমরা ক্রেডিবল মনে করবো না কেন? সোর্স তো একটাই। স্যাটারডে পোস্ট-এ ফারুক-রশিদ ইন্টারভিউ দেন। কর্নেল হামিদের বই থেকে আমি কোট করেছি। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এসব কথা বলেছেন। শনিবার রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল একাত্তরে এক টকশোতে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। সামিয়া রহমানের উপস্থাপনায় আলোচনায় অংশ নেন জাসদের কার্যকরী সভাপতি মাঈনউদ্দিন খান বাদল এবং সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘জাসদের উত্থাপন পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ নিয়ে যখন চারদিকে আলোচনা চলছে তখনই তিনি এ আলোচনায় অংশ নেন। তিনি বলেন, এই যে পাওয়ার স্ট্রাগল জিয়া ও খালেদ মোশাররফের মধ্যে- যেভাবেই হোক- কারণ ১৫ই আগস্ট যে মিলিটারি ক্যু তা অ্যাবসলিউট মিলিটারি ক্যু নয়। তা এক ধরনের আওয়ামী শাসন। আন্ডার খোন্দকার মোশ্‌তাক। ১৫ই আগস্ট মোশতাক মার্শাল ল’-ও জারি করেননি। ২০শে আগস্ট মোশতাক মার্শাল ল’ জারি করেন উইথ এফেক্ট ফ্রম ১৫ই আগস্ট। কিন্তু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেননি। কর্নেল তাহের ইনসিস্ট করেছেন মার্শাল ল’ জারি করার জন্য। তার এ কর্মকা-ের পেছনে হয়তো জাসদের সমর্থন ছিল না। মাঈনউদ্দীন খান বাদল এ সময় বলেন, সমর্থন ছিল না। মহিউদ্দিন আহমদের কাছে উপস্থাপিকা সামিয়া রহমান জানতে চান, আপনি আপনার বইয়ে লিখেছেন, ১৭ই আগস্ট নঈম জাহাঙ্গীর কর্নেল তাহেরের সঙ্গে দেখা করতে যান। সে সময় তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বলেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া। এই তথ্য আপনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন। ইতিহাসনির্ভর এত বড় ঘটনায় তথ্যের সত্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ না? জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা আসলে যে কোন গবেষণায় আমরা কি ধরনের মেথলজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করবো তা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। যেখানে লিখিত ডকুমেন্ট না পাই তখন আমরা ওরাল হিস্ট্রির কাছে যাই। সে জন্য আমরা অনেক সময় অনেকের কথা কোট করি। এগুলো সবসময় রেকর্ডেড থাকে না। এখন আমাদের বুঝতে হবে যে কি পরিস্থিতিতে কি ধরনের মাইন্ডসেট থাকলে একটা লোক এ ধরনের কথা বলতে পারে। এখন এ ধরনের কথা কর্নেল তাহেরের টেম্পারমেন্টের সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ণ কিনা সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আর নঈম জাহাঙ্গীর ইনফরমেশন সোর্স হিসেবে ক্রেডিবল কিনা- সেটাও  গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে তাকে ক্রেডিবেল মনে হয়েছে। তিনি তাহেরের সঙ্গে একই সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। তাহেরের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। এ প্রসঙ্গে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ওরাল হিস্ট্রি দুই রকম আছে। একটা হলো পপুলার ওরাল হিস্ট্রি। আপনি একটা জায়গায় ঘটনা ঘটলো সেখানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তথ্য নেবেন। যেখানে লিখিত ডকুমেন্ট থাকে না সেখানে গবেষকরা তা-ই করেন। তারপর তিনি যেটা বলেছেন, যিনি বলছেন, তার ক্রেডিবিলিটি কতুটুকু। যিনি বলছেন তার অবস্থানটা কি? তার বয়স কেমন? অন্যান্য কার্যক্রম কি? নঈম জাহাঙ্গীর তাহেরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তাই কর্নেল তাহেরের সঙ্গে তার কথা হতেই পারে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। তার রাজনৈতিক অবস্থান ছিল। যে কারণে মহিউদ্দিন আহমদ তাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন। এ পর্যায়ে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, মাঈনউদ্দিন খান বাদলের কাছে আমার একটি বিষয় জানার আছে। বইতে যেটা আছে ১৫ই আগস্ট ভোরবেলা কর্নেল তাহেরকে নিয়ে যাওয়া হয় রেডিও স্টেশনে। তিনি রেডিও স্টেশনে যান। তার মানে তিনি এই হত্যাকা-কে অনুমোদন করেন। রেডিও স্টেশনে শুধু যান তাই নয় তিনি ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন। তার মধ্যে ছিল এখনই মার্শাল ল’ জারি করতে হবে। তিনি খোন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বঙ্গভবনে যান। যদিও তার আগেই শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। সেখানে তিনি ফারুক-রশিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের এক পর্যায়ে তিনি জিয়াউর রহমানকে ডেকে নেন। এ সব ঘটনা প্রমাণ করে ১৫ই আগস্ট যা ঘটেছে কর্নেল তাহের তা এপ্রুভ করেন। এর মধ্যে কিন্তু জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাহেরের কোন সংঘাত আমি দেখি না। কিন্তু বাদল ভাই পরে কি ঘটনা ঘটলো হঠাৎ করে এখন আমরা যেটা বলি, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু যেটা বলেছেন যে জিয়াউর রহমান খলনায়ক কর্নেল তাহের নায়ক? কি এমন ঘটনা ঘটলো? আমরা তো এ পর্যন্ত বান্ধবই দেখছি। নায়ক-খলনায়কের দ্বন্দ্বটা আসলে আমি এ বই পড়েও বুঝতে পারিনি। মাঈনউদ্দিন খান বাদল বলেন, একটা জিনিস বলি আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এ ব্যাখ্যাকে আমি উড়িয়ে দেবো না। এখানে যেটা মনে রাখতে বলবো যে জাসদের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের সম্পৃক্ততা। জাসদ একটা পার্টি যে দলে দু’জন সেক্টর কমান্ডার যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মেজর জলিল এবং কর্নেল তাহের। এদের আবার আর্মিতে একটা লং এসোসিয়েশন আছে। যেটা ভুলে যাওয়ার দরকার নেই। ২০ বছরের এসোসিয়েশন আছে। উইথ জিয়া অ্যান্ড আদারস। সুতরাং প্রশ্ন হলো উনি ১৫ই আগস্ট কি করেছেন তা যদি বলেন তাহলে উনি যা যা করেছেন তা আমার পার্টির যে হাইকমান্ড পার্টির যে প্রক্রিয়া সে প্রক্রিয়াতে অনুধাবনযোগ্য নয় এবং অনুসরণযোগ্যও নয়। এটা আমরা কোন সিদ্ধান্ত নিইনি। কর্নেল তাহেরকে পার্টি কোন নির্দেশ দেয়নি, আপনি ওখানে যান আপনি এটা করেন সেটা করেন। হ্যাঁ, পার্টি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কাজ করেছে। এখন আপনি যদি বলেন, আইনের দৃষ্টিতে সেটা অন্যায় তা আপনি বলতেই পারেন। সামিয়া রহমান বলেন, খুনি মুজিব খুন হয়েছেন বলে একটি লিফলেট বিলি করা। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে পার্টি থেকে। জাসদ তো ফ্রম ৭২ শেখ মুজিবের উৎখাত চাইছিল। তাতে আমি অবাক হওয়ার মতো কিছু দেখি না। ৭৫ সালে যারা লিফলেট দিয়েছিল তারা তো আর জানতো না আওয়ামী লীগ ৯৬ সালে আবার ক্ষমতায় আসবে। তাহলে তো আর লিফলেট দিতো না।

No comments

Powered by Blogger.