নূর হোসেন দিবস- ‘ভাইকে খুব মনে পড়ে’ by তৌহিদা শিরোপা

ভাইবোনমাত্রই খুনসুটিতে মেতে থাকে। দেলোয়ার (৪৯), আনোয়ার (৪৫) বা সাহানার (৪১) ক্ষেত্রে অবশ্য তেমনটি ছিল না। তাঁদের ‘মাইজ্যা ভাই’ বেশ রাগী। এই ভাই থেকে ছোট ভাইবোনেরা দূরে দূরে থাকতেন। তবে তাঁদের এই ভাই যে অন্যদের থেকে আলাদা, সেটি তাঁরা জানতেন। ভাইও তাঁদের অনেক ভালোবাসতেন, তাঁরাও। পুরান ঢাকার বনগ্রামে থাকতেন তাঁরা। দুই কামরার সেই ছোট্ট বাড়িটিতে অভাব লেগে থাকত। অভাব যেন এই পাঁচ ভাইবোনের সম্পর্ক আরও মজবুত করে দিয়েছিল। তাঁরা সারাক্ষণ একে অপরের কথা ভাবতেন।

>>(বাঁ থেকে) নূর হোসেনের ভাই আনোয়ার হোসেন, বোন সাহানা এবং আরেক ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন l ছবি: প্রথম আলো
সত্যিই এই ভাই অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি শুধু পরিবার নয়, তাঁর ভাবনা ছিল দেশ নিয়েও। তাই তো দেশের জন্য জীবন দিলেন। আমরা সেই নূর হোসেনের কথা বলছি। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গণতন্ত্রের মুক্তির মিছিলে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—এই কথা পিঠে লিখে বের হন। সে সময় ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। তাই ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যে ছেলেটি দেশের জন্য জীবন দিতে পিছপা হলেন না, তাঁর পরিবার এখন কেমন আছে?
এ বছরের ৬ নভেম্বর ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে কথা হয় নূর হোসেনের বোন সাহানা, ছোট দুই ভাই দেলোয়ার হোসেন ও আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তাঁদের বড় ভাই আলী হোসেন (৫৫) প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়িচালক। কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি সেদিন আসতে পারেননি। এই ভাইবোন তাঁদের কথা বলতে বলতে ফিরে গেলেন পুরান ঢাকার সেই বাড়িতে।
সাহানা বলেন, ‘তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। একমাত্র বোন ছিলাম তো, খুবই আদর করতেন আমাকে। বাইরে কেউ কিছু খেতে দিলে সেটি না খেয়ে আমার জন্য আনতেন। ভাইয়ের মৃত্যুর আগের রাতেও একটি ফল (এখন নাম মনে নেই) আমার জন্য এনেছিলেন। ভাই একটু রাগী প্রকৃতির ছিলেন। তাই ভাইয়ের কাছে খুব একটা যেতে চাইতাম না। ভাই-ই আমাকে কাছে ডেকে গল্প করতেন। কত বছর হলো ভাই নেই, কিন্তু সব সময় তাঁকে খুব মনে পড়ে।’
নূর হোসেনের বাবা মজিবুর রহমান বেবিট্যাক্সিচালক ছিলেন। নূর হোসেনের লাশ পর্যন্ত তিনি দেখতে পারেননি। ২০০৫ সালে মজিবুর রহমান মারা যান। নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবি মেেজা ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এখনো বেঁচে আছেন।
১৯৮৭ সালের ৯ নভেম্বর রাতে ফেরেননি নূর হোসেন। পরদিন সচিবালয় ঘেরাও হবে, তাঁদের ছেলে নিশ্চয় সেখানে যাবে, সেই আশঙ্কা থেকে ছেলেকে খুঁজতে বের হন মজিবুর রহমান ও মরিয়ম বিবি। ১০ নভেম্বর ভোরে তাঁরা মতিঝিলের ডিআইটি মসজিদে (বর্তমানে রাজউক মসজিদ) গিয়ে দেখতে পান ঘুমাচ্ছেন নূর হোসেন। মায়ের ডাক শুনে ঘুম থেকে ওঠেন। পিঠের লেখা তাঁদের চোখ থেকে আড়াল করতে একটি চাদর গায়ে দেন। কিন্তু মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কি এতই সহজ? শঙ্কায় মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। মাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় পেয়ো না। কিছু হবে না। মিছিলে গেলেও আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।’
২৭ বছর হয়ে গেছে, মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে আসেনি। সরকার থেকে মিরপুরের মাজার রোডে একটি জায়গা পায় নূর হোসেনের পরিবার, ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৮ সালে টিনশেড বাড়ি করে নূর হোসেনের মা-বাবাসহ ভাইবোনেরা এই বাসায় থাকতেন। এরপর ২০০৭ সালে কাসেরো নামের একটি আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে জায়গাটি দেন। এখানে ‘শহীদ নূর হোসেন টাওয়ার’ নামে একটি ভবন নির্মাণ করা হবে, এমনটিই কথা হয়। তিন বছরের মধ্যে সব বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও আজ প্রায় আট বছর হয়ে গেছে, বেসমেন্ট ছাড়া ভবনের আর কোনো কাজ হয়নি। এটি নিয়ে এখন বিপদে পড়েছেন তাঁরা।
নূর হোসেনের ভাই দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ও আনোয়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সাহানার স্বামীও ছোটখাটো ব্যবসা করে। নিজেরা লেখাপড়া করতে পারিনি। আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন কোনো কষ্টে না থাকে, সেটা চাই। ওরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে, এমনটিই চাওয়া। এই টাওয়ার নির্মিত হলে আর্থিকভাবে কিছুটা সচ্ছল হব আমরা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান আমাদের আট বছর ধরে বিপদে ফেলে রেখেছে।’
বনগ্রামের বাড়ির বিছানায় শুয়ে নূর হোসেন স্বপ্ন দেখতেন, এই ঘিঞ্জি বাড়ি ছেড়ে একদিন বড় একটি বাড়িতে থাকবেন তাঁরা। তাঁর রক্তের বিনিময়ে সেই বড় বাড়ি তৈরির জায়গা পেয়েছে তার পরিবার। কিন্তু বাড়ি তৈরি না হওয়ায় থাকতে পারছে না। নূর হোসেনের ছোট্ট একটি স্বপ্ন কি পূরণ হবে না?
নূর হোসেনের মা ৬৭ বছর বয়সী মরিয়ম বিবি চান, নূর হোসেন টাওয়ার নির্মাণ করা হোক দ্রুত। তিনি মারা যাওয়ার আগে যেন দেখে যেতে পারেন। তাঁর ছেলের আত্মদানের কথা, স্বপ্নের কথা নতুন প্রজন্ম জানুক।

No comments

Powered by Blogger.