তদন্ত শেষ হয়নি ৬ মাসেও by নুরুজ্জামান লাবু

বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার ছয় মাস পার হতে চলেছে। কিন্তু এখনও আলোর মুখ দেখেনি কোন তদন্ত। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকারের উচ্চপর্যায়ের গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেননি। আর পুলিশি তদন্তও চলছে ঢিমেতালে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, সাত খুনের ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ঘটনা। ঘটনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। এ কারণে তদন্তে সময় লাগছে। এদিকে সাত খুনের ঘটনার অন্যতম আসামি ভারতের কারাগারে বন্দি নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রশাসনিক কমিটি ও পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নূর হোসেনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা গেলে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি শতভাগ খোলাসা হয়ে যেতো। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
চলতি বছরের ২৭শে এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ছয়জনের লাশ, পরদিন আরেকজনের লাশ পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ ও খুনের ঘটনায় নিহত প্যানেল মেয়র নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে নূর হোসেন, শাহজালাল বাদল, আমিনুল ইসলাম রাজু, ইকবাল হোসেন, হাজী ইয়াসিন ও হাসমত আলী হাসুসহ অজ্ঞাত ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। আইনজীবী চন্দন সরকারের পক্ষেও তার জামাতা বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন। ঘটনার পর নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান দাবি করেন, নারায়ণগঞ্জের আরেক কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেন র‌্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে তার জামাতাকে হত্যা করিয়েছে। এর পরই সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব ১১-এর কমান্ডিং অফিসারসহ অন্যদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন বলেন, মামলার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের অনেকেই গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আরও কয়েকজন পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পুলিশ সুপার বলেন, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আমরা আমাদের সব কাগজপত্র যথাযথ জায়গায় দিয়েছি। নূর হোসেনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনতে পারলে তদন্তের গতি আরও ত্বরান্বিত হতো।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাব ১১-এর সাবেক কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লে. কমান্ডার রানা ও মেজর আরিফসহ ১১ জন র‌্যাব সদস্য। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলো এসআই পূর্ণেন্দু বালা, ল্যান্স নায়েক হীরা, ল্যান্স নায়েক বেলাল, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমীন, হাবিলদার এমদাদ, হাবিলদার আরিফ হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব ও কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমীন ছাড়া অন্যরা সবাই সাত খুনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্ত সূত্র জানায়, ঘটনার পর থেকে গত ছয় মাসে এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী নূর হোসেনের ১৪ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে নূর হোসেনের দুই সহযোগী মর্তুজা জামান চার্চিল ও আলী মোহাম্মদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সূত্র জানায়, এর বাইরে কয়েকজন র‌্যাব সদস্যসহ ১৪ জনকে আদালতে নিয়ে সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য রেকর্ড করা হয়েছে।
ধরাছোঁয়ার বাইরে আরও ১১ র‌্যাব সদস্য: মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব ১১-এর ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তা ছাড়াও আরও অন্তত ২২ সদস্য জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন। এদের মধ্যে তিন কর্মকর্তাসহ ১১ জনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবদুস ছালাম, সামাদ ও মেজর আরিফের গাড়ি চালক নায়েক দেলোয়ার নামে তিন র‌্যাব সদস্য ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘটনার পর থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন আরও অন্তত ১১ জন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। ঘটনার পর এ র‌্যাব সদস্যদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হলেও তারা সবাই পলাতক রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পলাতক র‌্যাব সদস্যরা হলো এসআই পলাশ গোলদার, নায়েক নাজিম উদ্দিন, নায়েক আবদুর রাজ্জাক, সিপাহি আজম আলী, কনস্টেবল মিজানুর রহমান, নায়েক নাজিম উদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, করপোরাল মোহাম্মদ মোখলেস, সিপাহি আজম আলী ও কনস্টেবল মিজানুর রহমান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা নিম্নপর্যায়ের অনেক সদস্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুকুম পালন করেছেন। এ কারণে এদের অনেককেই সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি রেকর্ড করা হচ্ছে। তবে যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তাদের নাম চার্জশিটে দেয়া হবে।
গ্রেপ্তার হয়নি এজাহারভুক্ত আসামিরাও: সাত খুনের ঘটনায় নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি নূর হোসেনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অন্যরা হলো সিদ্দিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়া, ঠিকাদার হাসমত আলী হাসু, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রাজু, নূর হোসেনের সহযোগী আনোয়ার হোসেন আশিক ও বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেন। এদের মধ্যে মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নূর হোসেনকে গত ১৪ই জুলাই রাতে কলকাতার কৈখালীর বাগুইহাটি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি পাঁচজনের মধ্যে হাসমত আলী হাসুকে গ্রেপ্তারের গুজব উঠলেও শেষ পর্যন্ত আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এজাহারভুক্ত অন্যদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। সূত্র জানায়, মামলা করার পরপরই এজাহারভুক্তরা সবাই দেশের বাইরে পালিয়ে যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এজাহারভুক্ত সবার বিরুদ্ধেই তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনা হবে কবে?: সাত খুনের ঘটনায় অন্যতম মাস্টারমাইন্ড নূর হোসেন কলাকাতায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও তাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে আছে। গ্রেপ্তারের পর তাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা থাকলেও এ নিয়ে জোর তৎপরতা নেই। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সব কাগজপত্র গুছিয়ে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। এখন এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। তাকে ফিরিয়ে না আনা হলে তদন্তে কিছু বিষয় ফাঁক থেকে যেতে পারে। কারণ গ্রেপ্তারকৃত সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তা নূর হোসেনের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এড়িয়ে গেছেন। এটা এখন নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই জানা সম্ভব। প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, ঘটনাটির তদন্ত পরিপূর্ণভাবে করতে তারাও নূর হোসেনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা বা কলকাতা গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিলেন। এ-সংক্রান্ত একাধিক চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোন সাড়া পাননি তারা।
প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির কাজও শেয় হয়নি: সাত খুনের ঘটনার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান আলী মোল্লার নেতৃত্বে সাত সদস্যের এ কমিটি সাত খুনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকা ও দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। ছয় মাস পার হতে চললেও এ কমিটি এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। প্রতিবেদন জমাদানের সময় শেষ হওয়ার পর অগ্রগতি প্রতিবেদন দিয়ে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। তবে কমিটির সদস্য সচিব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কাশেম মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, কমিটির কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে। শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন উচ্চ আদালতে জমা দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কমিটি ইতিমধ্যে চার শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নিয়েছে। এদের মধ্যে ভিকটিম পরিবার, গণশুনানি করে নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জের স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য নেয়া ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সূত্র জানায়, সাত খুনের ঘটনার সময় নারায়ণগঞ্জে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপার নূরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল, সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী, র‌্যাবের এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান, র‌্যাব ডিজি মোখলেছুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ ছাড়া তদন্ত কমিটির সদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে র‌্যাব ১১-এর অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাসহ অন্য র‌্যাব কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে। কমিটির একটি সূত্র জানায়, কমিটি তাদের প্রতিবেদনে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ ছাড়াও তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও উল্লেখ করবে। এ ছাড়া র‌্যাবের কার্যক্রম নিয়ে কমিটি কিছু সুপারিশও করবে।

No comments

Powered by Blogger.