মোসাদ ও ম্যাককেইন আইএসের জন্ম দিয়েছে by ফিদেল ক্যাস্ট্রো

নিঃসন্দেহে কারো অধিকার নেই নগরগুলোকে ধ্বংস, শিশুদের হত্যা, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং কোথাও সন্ত্রাস, ক্ষুধা ও মৃত্যুর কারণ সৃষ্টি করার। বিশ্বসম্প্রদায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো শান্তির মুখ দেখেনি। অতীতে বিশেষ করে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায় (ইইসি) যখন যুক্তরাষ্ট্রের চরম নির্দেশনায় সিদ্ধান্ত নিলো যে, দু’টি বড় দেশের যা অবশিষ্ট আছে, তার একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে, তখন থেকে শান্তি আর নেই। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এর অবসান ঘটাতে ওই দুটো দেশ বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে।
সাবেক রাশিয়ায় একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, যা নাড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীকে। প্রত্যাশা ছিলÑ ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের মতো সর্বাধিক শিল্পায়িত দেশগুলোতেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটবে; কিন্তু তা ঘটে গেল রাশিয়ায়, যার ভূখণ্ড উত্তর ইউরোপ থেকে দক্ষিণ আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই আলাস্কা ছিল জার শাসিত অঞ্চল। এটা কিছু ডলারের বিনিময়ে এমন এক দেশের কাছে বেচে দেয়া হয়েছিল, যারা বিপ্লব ঘটে যাওয়া দেশগুলোতে হামলা ও ধ্বংসের দিকেই পরে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। মানুষ যদি অন্যদের মাঝে তার ভাই-বন্ধুকে পেত এবং হত্যায় উদ্যত সশস্ত্র শত্রুকে দেখতে পেত না, তাহলে কি এই বিশ্বে অনেক বেশি ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হতো না?
নগর ও বাড়িঘর ধ্বংস, শিশুহত্যা, সন্ত্রাস সৃষ্টি, খাদ্যাভাব ও মৃত্যু ডেকে আনাÑ এসব করার কোনো অধিকার কারো নেই। যখন সর্বশেষ বিশ্বযুদ্ধের হত্যাযজ্ঞের অবসান হয়েছিল, বিশ্ব আশার আলো দেখেছিল জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার মধ্যে। যদিও এই বিশ্বসংস্থার লক্ষ্যগুলো পুরোপুরি তুলে ধরা হয়নি, তবুও মানবজাতির একটা বৃহৎ অংশ একে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। তবে আজ যা দেখা যাচ্ছে, তা এক বিশাল প্রতারণা। কারণ, সঙ্কটের পর সঙ্কট জন্ম নিচ্ছে, যা বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এ যুদ্ধে এমন সব অস্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে, যা মানবজাতির অস্তিত্বের বিনাশ ঘটাতে সক্ষম।
এখন বিশ্বরঙ্গমঞ্চে এমন সব কাণ্ডজ্ঞানহীন অপরিণামদর্শী লোকজন রয়েছে, যারা মৃত্যু ডেকে আনাকে মেধার পরিচয় মনে করে। ওরা নিজেদের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিতে মানুষ হত্যা করাকে মনে করে বুদ্ধিমানের কাজ। ইউরোপে ন্যাটোর কিছু কর্তাব্যক্তির বক্তব্য শুনে অনেকেই অবাক হচ্ছেন। তাদের ধরন ও দৃষ্টিভঙ্গি নাৎসি এসএস বাহিনীর মতো। কোনো কোনো উপলক্ষে এরা এমনকি ভর গ্রীষ্মেও কালো স্যুট পরিধান করে।
আমাদের আছে বেশ শক্তিশালী এক বৈরী। তা হচ্ছে, নিকটতম পড়শি যুক্তরাষ্ট্র। আমরা হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম, তাদের অবরোধকে মোকাবেলা করবই, যদিও আমাদের দেশকে এ জন্য চড়া মাশুল গুনতে হবে। যে শত্রু কোনো কারণ, যুক্তি ও অধিকার ছাড়াই আপনাকে আক্রমণ করে বসে, তার কাছে নতিস্বীকার করার চেয়ে বড় ক্ষতি আর নেই। এটাই ছিল বিচ্ছিন্ন ও ুদ্র এক জনগোষ্ঠীর (কিউবা) অনুভূতি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, গোলার্ধের দেশগুলোর সরকার সেই শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদীর পক্ষেই ছিল। আমাদের ুদ্র জাতিটি শতাব্দীর শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছিল। এর আগে আমরা পাঁচ শ’ বছর ধরে স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসনে দুর্ভোগের শিকার হয়েছি। তখন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিপুল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নপুংসক কংগ্রেসের ঘাড়ে সংবিধানের এমন এক সংশোধনী চাপিয়ে দিয়েছিল, যার অজুহাতে দেশটি কিউবায় সামরিক হস্তক্ষেপ চালানোর অধিকার পেয়ে যায়। কিউবার প্রায় পুরো ভূখণ্ড, বিস্তীর্ণ ভূমি, সর্ববৃহৎ চিনিকলগুলো, খনি ও ব্যাংকÑ সব কিছুর মালিক ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি কিউবার মুদ্রা ছাপানোর অধিকারও ছিল আমেরিকার। এমন এক অবস্থায় ওরা আমাদের প্রয়োজনমাফিক শস্য উৎপাদন করতেও দিত না। আমরা কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সমাজতান্ত্রিক শিবির বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও প্রতিরোধ চালিয়ে গেছি। আমাদের বিপ্লবী রাষ্ট্র ও জনগণ স্বাধীনভাবে অগ্রযাত্রা রেখেছে অব্যাহত।
এত কিছু সত্ত্বেও আমাদের আধুনিক যুগের ইতিহাসকে নাটকীয় রূপ দিতে চাই না। বরং জোর দিয়ে এটাই বলব, মার্কিন নীতি এতই হাস্যকর যে, এটি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে খুব বেশি বিলম্ব হবে না। লোভতাড়িত হিটলারের সাম্রাজ্য ইতিহাসের পাতা থেকে বিদায় নেয়ার পর যা ঘটেছে, তা হলোÑ ন্যাটোর আগ্রাসী বুর্জোয়া সরকারগুলোকে উসকে দেয়া। ওরা এখন শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্বের কাছে হাসির পাত্র। তাদের ইউরো ও ডলার শিগগিরই নিছক ভেজা কাগজে পরিণত হবে। ওদের নির্ভর করতে হবে ইয়েন ও রুবলের ওপর, যদি রাশিয়ার বিশাল অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্ভাবনার সাথে ঘনিষ্ঠতা রেখে চীনা অর্থনীতির উত্থান ঘটতে থাকে।
উন্নাসিক হামবড়া ভাব মার্কিন সাম্রাজ্যের অনুসৃত নীতির বৈশিষ্ট্য। এটা জানা আছে যে, ২০০৮ সালে জন ম্যাককেইন ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী। তাকে জনগণের সামনে তুলে ধরা হলো এই পরিচয়েÑ ভিয়েতনাম যুদ্ধে তিনি বোমারুবিমান চালিয়ে জনবহুল হ্যানয় নগরীতে বোমা ফেলেছিলেন। তখন মিসাইল নিক্ষেপ করে বিমানটি নামানো হয়। (তদানীন্তন উত্তর) ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ের উপকণ্ঠে একটি হ্রদে গিয়ে পড়ে ম্যাককেইনসহ বিমানটি। সেই এলাকায় থাকতেন ভিয়েতনামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈন্য। তিনি দেখলেন, একটি বিমান ভূপাতিত হয়েছে এবং পাইলট বাঁচার চেষ্টা করছেন। তিনি ছুটে এলেন বিমান চালককে সাহায্য করার জন্য। তখন হ্যানয়ের কিছু বাসিন্দা দৌড়ে এসে হাজির হলো। তারা মার্কিন বিমান হামলায় ক্ষতির শিকার হয়েছিল। লোকগুলো এই খুনি পাইলটের এসপার-ওসপার একটা বিহিত করতে চাইলো। অবসরপ্রাপ্ত সৈন্য তাদের বাধা দেন। কারণ, এ পাইলট ততক্ষণে বন্দী হয়ে গেছে বলে তাকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা দরকার। এরপর মার্কিন কর্তৃপক্ষ ভিয়েতনাম সরকারের সাথে যোগাযোগ করে আবেদন জানায়, যাতে এই পাইলটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয়।
ভিয়েতনাম সরকার যুদ্ধবন্দীদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদানের নীতি অনুসরণ করত। তদুপরি, ধৃত মার্কিন পাইলট ছিল সে দেশের নৌবাহিনীর একজন অ্যাডমিরালের ছেলে। এই সেনাপতি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। তার ছেলে ভিয়েতনামে আটক হওয়ার সময়ও তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন অধিষ্ঠিত।
ভিয়েতনামিরা সেদিন একটা ‘বড় মাছ’ই ধরেছিল ম্যাককেইনকে পাকড়াও করে। অপর দিকে শান্তি আলোচনা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধের অবসান ঘটাবেÑ এই বিবেচনায় তারা ম্যাককেইনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিল। এই সুযোগ ব্যবহার করতে পেরে ম্যাককেইন খুব খুশি হয়েছিলেন।
অবশ্য কোনো ভিয়েতনামি আমাকে এ ধরনের কথা বলেনি। আমি এ বিষয়ে পড়েছি। আমার অধ্যয়নলব্ধ এ জ্ঞান মিলে যায় ওই ঘটনা সম্পর্কে পরে জানা বিশদ বিবরণের সাথে। এটাও পড়ে জেনেছি যে, ম্যাককেইন লিখেছেনÑ তিনি ভিয়েতনামে বন্দী থাকাকালে নির্যাতিত হয়েছেন। তখন ভিয়েতনামে দায়িত্বরত ও স্প্যানিশভাষী মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছেন। তারা নির্যাতনকারীদের পরামর্শ দিচ্ছিল নির্যাতন কিভাবে চালাতে হবে, সে ব্যাপারে।
ম্যাককেইনের মতে, এই কণ্ঠস্বর কিউবার নাগরিকদের; কিন্তু ভিয়েতনামে কখনো কিউবা কোনো উপদেশদাতা পাঠায়নি। ভিয়েতনামি সামরিক বাহিনীর নিজেরই জানা ছিল, তাদের কিভাবে যুদ্ধ চালাতে হবে।
ভিয়েতনামের জেনারেল গিয়াপ আমাদের এ যুগের সবচেয়ে প্রতিভাবান সমরকুশলীদের একজন। তিনি দিয়েন বিয়েন ফুতে প্রত্যন্ত পার্বত্য জঙ্গলে মিসাইল লঞ্চার বসাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অথচ ইয়াংকি (মার্কিন) আর ইউরোপিয়ান সেনা অফিসাররা ভেবেছিলেন, এটা অসম্ভব। এভাবে ভিয়েতনামিরা শত্রুর এত কাছ থেকে গোলাগুলি বর্ষণ করত যে, তাদের কাবু করা সম্ভব ছিল না। আর তা করতে গেলে আক্রমণকারী আমেরিকানদের নিজেদেরই ক্ষতি হতো। আরো অনেক কঠিন ও দুরূহ পদক্ষেপ নিয়ে ভিয়েতনামে অবরুদ্ধ শত্রুবাহিনীকে লজ্জাকর আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়েছিল।
খেঁকশিয়ালের মতো ধূর্ত, ম্যাককেইন মার্কিন ও ইউরোপিয়ানদের সামরিক পরাজয় থেকে যতটা সম্ভব ফায়দা লুটেছিলেন। তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন একদিন আয়েশি ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘হেনরি, আমরা কেন একটা হলেও ওই ছোট বোমাগুলো ফেলছি না?’ কিন্তু তার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার এই আইডিয়া গ্রহণ করেননি। আসলে ‘ছোট্ট বোমা’টি বর্ষিত হয়েছিল, যখন এই প্রেসিডেন্টের লোকেরা তাদের প্রতিপক্ষ দলের লোকজনের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি চালাতে চেষ্টা করেছিল।
যা হোক, মিস্টার ম্যাককেইন তার সবচেয়ে উন্নাসিক আচরণ দেখিয়েছেন নিকট প্রাচ্যের ক্ষেত্রে। মোসাদের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত, ইসরাইলের এমন বন্ধুদের মধ্যে সিনেটর ম্যাককেইন সবচেয়ে নিঃশর্ত ভালোবাসা প্রদানকারী। এ দিক দিয়ে তিনি যে কত বেশি অগ্রসর, তা তার সবচেয়ে বড় শত্রুরও কল্পনা করা কঠিন। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জন্ম দেয়ার কাজে মোসাদ গোয়েন্দা সংস্থার সাথে ম্যাককেইনও অংশ নিয়েছেন। ইতোমধ্যেই আইএস ইরাকের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এবং সিরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ দখল করে নিয়েছে। আইএসের তহবিলে আছে অনেক মিলিয়ন ডলার। ওরা সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে, যারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বেশি জোগানদাতা।
লেখক : কিউবার বিপ্লবের নায়ক এবং দীর্ঘকালীন প্রেসিডেন্ট
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
[মান্থলি রিভিউর সৌজন্যে]

No comments

Powered by Blogger.