এ কি দুর্ঘটনা, নাকি হত্যা? by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
বনপাড়া সিরাজগঞ্জ মহাসড়কে এক ভয়াবহ দু’টি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে কিয়ামতের আলামতের সৃষ্টি হয়েছে। পত্রপত্রিকায় দেখেছিলাম রেজ্জুর মোড়ের দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা শতাধিক। দুই বাসে লোকই থাকে কত? এত লোক নিহত হয় কী করে? বুকটা কেঁপে উঠেছিল। প্রতিদিনই দেখছি সড়ক দুর্ঘটনা। সরকারি হিসাবে প্রতি বছর ১২ হাজার, বেসরকারি ১৮ হাজার, এনজিওদের হিসাবে ২৪ হাজারের ওপরে। যদি বছরে ২৪ হাজার হয় তাহলে প্রতিদিন মরে ৬৫ জন। কোনো কোনো েেত্র দুর্ঘটনায় যে জীবন হারায় শুধু সেই মরে না, তার পরিবার-পরিজন নিয়ে মরে। নাটোরের গুরুদাসপুরের শিধুলীতে এক কবরস্থানে ১৪ জনকে দাফন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে আর কোথাও সারিবদ্ধ ১৪ কবর দেখিনি। আজ মনে হচ্ছে, শিধুলী না গেলে বড় অন্যায় করতাম। মহাসড়কের যেখানে দু’টি বাস দুমড়েমুচড়ে রাস্তার দু’পাশে পড়ে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে, সরেজমিন না দেখলে কী অন্ধকারেই যে থাকতাম তোমাকে বলতে পারব না। খবর ছিল সড়ক দুর্ঘটনা, কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যদর্শীদের হৃদয়বিদারক বিবরণ শুনে আর দুর্ঘটনা বলে মন সায় দিতে চায়নি।
তোমার সময় যাতায়াতব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না, এত গাড়ি-ঘোড়া ছিল না। ঢাকা থেকে গুরুদাসপুর দু’দিনেও যাওয়া যেত না; কিন্তু এখন কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। ঢাকা থেকে নাটোরের গুরুদাসপুর ১৯০ কিলোমিটার। তাই ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে রাত কাটিয়েছিলাম। ঘড়ির কাঁটায় তাল মিল রেখে ২৪ তারিখ শুক্রবার সকাল ৯টায় গুরুদাসপুরের রেজ্জুর মোড়ে রওনা হয়েছিলাম। পথে সিরাজগঞ্জ মোড়ে সানোয়ার হোসেন জজ মিয়াদের সাথে দেখা করে দু-চার কথা বলে পৌনে ১১টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে যা শুনলাম, যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য। সেই ’৬০ সাল থেকে গাড়ি চালাইÑ কোনো দিন কল্পনাও করিনি সেই অকল্পনীয় অভাবনীয় ঘটনাই তোমাকে বলছি। ৩টা কয়েক মিনিট হবে নাটোরের অথৈই পরিবহনের একটি গাড়ি ওপর নিচে ঠাসা যাত্রী নিয়ে বনপাড়া থেকে সিরাজগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। সেই সময় একটি ট্রাক পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িটিকে ধাক্কা মেরে চলে যায়। মনে হয় অনেক বেশি যাত্রী থাকায় ড্রাইভার গাড়িটিকে সামলাতে পারছিল না। মাতালের মতো ডানে বামে মোচড়ামুচড়ি করে প্রায় দেড়-দুই শ’ গজ গিয়েছিল। সেই সময় ঢাকার দিক থেকে কেয়া পরিবহনের একটি দূরপাল্লার গাড়ি নাটোরের দিকে যাচ্ছিল। সামনের গাড়ির টালমাটাল অবস্থা দেখে কেয়া পরিবহনের চালক তার গাড়ি বাঁ পাশের বিকল্প পথে নামিয়ে দেয়। তুমি হয়তো জানো না, সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মোড় থেকে বনপাড়া পর্যন্ত চলনবিলের মধ্য দিয়ে নির্মিত রাস্তার এক পাশে চমৎকার উপপথ তৈরি করা হয়েছে। যেখান দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি, রিকশা, টেম্পো, নছিমন চলাচল করে। কেয়া পরিবহনের গাড়ি প্রায় এক দেড় ফুট নিচু উপপথে নামিয়ে দিতে গিয়ে চালক যখন দেখে তার গাড়ি বাঁ দিকে পড়ে যাচ্ছে, তখন সে আবার তার গাড়ি ডান দিকে টেনে রাখার চেষ্টা করে। এ সময় রাস্তার কয়েকটি সীমানা পিলার ভেঙে আবার মূল রাস্তায় উঠে অথৈই পরিবহনের ওপর প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ে। দূরপাল্লার কেয়া পরিবহনের ছাদে দু-চারজন থাকলেও অথৈই পরিবহনের ছাদে ৪০-৫০ জনের নানা বয়সী যাত্রী ছিল। একটি আর একটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে দুই গাড়ি সড়কের দুই দিকে ছিটকে পড়ে। দুই গাড়ির ছাদের প্রায় সব যাত্রী রাস্তার ওপর এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। অনেকেই আহত হলেও সবাই যে নিহত হয়েছিল তেমন নয়। কেউ কেউ অতও ছিল; কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যের একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটে তারপর। কেয়া পরিবহনের পিছে পিছে ধেয়ে আসা হানিফ পরিবহনের একটি গাড়ি রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষদের দেখে না থামিয়ে তার ওপর দিয়ে চলে যায়। এ সময় কতজন যে নিহত হয়েছে কেউ বলতে পারে না। কারবালার প্রান্তরে সীমার যে নির্মমতার পরিচয় দিয়েছিল, গুরুদাসপুরে হানিফ পরিবহনের নির্মমতা তারচেয়েও জঘন্য বেদনাদায়ক। কেয়া এবং অথৈই পরিবহনের গাড়ির সংঘর্ষ দুর্র্ঘটনা হিসেবে মেনে নিলেও রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা মানুষদের ওপর দিয়ে হানিফ পরিবহনের গাড়ি চালিয়ে দেয়াকেও কি দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে হবে? একে তো নির্মম গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে মন সায় দেয় না। তুমি তো জানোই, আমার প্রিয় ছোট একটি মেয়ে আছে। দিন দিন তার কর্তৃত্ব নেতৃত্ব বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠ হচ্ছে। সেই কুশিমণি যখন চার সাড়ে চার বছরের তখন ওর মা ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছিল। হঠাৎই একটি কুকুর গাড়ির নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। মা আমার বাসায় ফিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। আমার কাছে নালিশ করে, ‘আব্বু, যীশুকে বাদ দিয়ে দাও। ও কুকুর মারতে চায়। ও ভালো না, কুকুরটা মরলে কেমন হতো?’ আসলে কুশিমণির কথা ফেলতে পারি না। তার সব কথা মায়ের কথার মতো মেনে চলার চেষ্টা করি। অনেক বলে কয়ে বাবার দেয়া চালক যীশুর চাকরি সে যাত্রায় রা করা হয়েছিল। তারপরও
রাস্তাঘাটে গাড়ির সামনে ছাগল কুকুর বিড়াল পড়লেই কুশিমণি চিৎকার করে ওঠে, ‘যীশু, তুই কিন্তু কুকুর মারবি না।’ আসলেই যীশু কুশিকে নিয়ে সব সময় তটস্থ থাকে। ছোট্ট একটি শিশু, যার এখন সাড়ে সাত বছর বয়স। রাস্তার কুকুর বিড়াল পশুপাখির ওপর যাতে গাড়ি না ওঠে তার জন্য কত  চিন্তা, আর গুরুদাসপুরে রেজ্জুর মোড়ে দুর্ঘটনায় পতিত মানুষের ওপর দিয়ে হানিফের গাড়ি চলে গেল? মাননীয় নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের আশকারা পাওয়া ড্রাইভারের বুকে একটুও বাধলো না? তাহলে তার কিসের আত্মা? কোনো পশুর আত্মাও তো এমন হিংস্র্র হতে পারে না। কোথায় মনুষ্যত্ব, কোথায় মানবতা? এ তো হিংস্র্রতার চরম প্রকাশ।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে অসংখ্য মানুষ খুন করলেও এখন পর্যন্ত হানিফ পরিবহনের সেই গাড়ি এবং ড্রাইভারকে শনাক্ত করতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যে ট্রাক অথৈই পরিবহনকে ঘেঁষা দেয়ায় ঘটনার সূত্রপাত, সেই ট্রাককে যেমন শনাক্ত করা হয়নি। হানিফ পরিবহন কতজনকে যে হত্যা করেছে- তাকেও শনাক্ত করা হয়নি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম, বিআরটিসির বিজ্ঞাপনে দেখলাম যেহেতু তারা হানিফ পরিবহনের গাড়ি শনাক্ত করতে পারেনি সেহেতু জনসাধারণ যদি নাম্বার দিতে পারেন তাহলে ভালো হয়। কী নির্লজ্জ আহ্বান! একটা খুনি গাড়ি শনাক্ত করতে সরকারের খুব একটা বেশি সময় লাগে? ৩টা  সাড়ে ৩টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে। ওই সময় সিরাজগঞ্জ বনপাড়া দিয়ে হানিফ পরিবহনের কোন কোন গাড়ি গেছে অবলীলায় বলে দেয়া যায়। নাটোর-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ ওই রাস্তায় হানিফ পরিবহনের ক’টা গাড়ি চলেÑ এটা খুঁজে বের করতে কতণ? ৫-১০-২০টা। যদি তাই হয় সব ক’টা গাড়ি ধরতেই-বা দোষ কোথায়? যে কেয়া পরিবহনের গাড়ি দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে তার পেছনে হানিফ পরিবহনের কোন গাড়ি ছিল সহজেই তো তার খবর নেয়া যেতে পারে। যেখান থেকে ছাড়ে সেখান থেকে, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড় থেকে সিরাজগঞ্জের মোড়ে ২টা আড়াইটায় হানিফের কোন গাড়ি রাস্তায় হোটেলে খাবার খেয়েছে এসব খোঁজ করলেই তো বেরিয়ে যায়; কিন্তু খোঁজ করবে কে? ইচ্ছা থাকতে হবে তো। গরিব মরলে সরকারের কী? শিধুলীর এক বাড়িতে সাত ভাইয়ের ছয়জনই মারা গেছে। তাদের সংসার এখন রাস্তায়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী গিয়েছিলেন নিহতদের চেক দিতে। এক সারিতে ১৪টি কবর দেখে আমি কিছুটা দিশেহারা হয়েছিলাম। তাই সাংবাদিকদের বলেছিলাম, মাননীয় মন্ত্রীর অদতা অযোগ্যতার জন্য এলাকার মানুষ তার কাছে অনুদান চায় না। তার পদত্যাগ চায়। অনেকেই বলেন পশ্চিমবঙ্গের এক সিনেমার নায়ক ফাটা কেষ্টের মতো তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, রাস্তা ঠিক হয় না। মন্ত্রীর কাজ কি রাস্তার সুপারভাইজারের মতো, ওভারশিয়ারের মতো ইট বালু দেখা? সে তো S.D-S.O.-এর কাজ, Exn-এরও কাজ না। সেখানে মন্ত্রী ঘুরলে সব ইঞ্জিনিয়ারও তার পিছে পিছে ঘোরে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। তার কাজ ছিল হানিফ পরিবহনের খুনি গাড়িকে চিহ্নিত করা। যদি ধরা না যায়, তারা যদি ভালোয় ভালোয় স্বীকার না করে তাহলে সারা দেশের সব হানিফ পরিবহনের গাড়ি বন্ধ করে দেয়া উচিত। রাস্তার ওপর মানুষ থাকলে তার ওপর দিয়ে যে পরিবহনের নরঘাতক ড্রাইভারেরা গাড়ি চালিয়ে যেতে পারে, তাদের রাস্তায় মানুষ হত্যার অধিকার কেউ দেয়নি। এসব কোনো পদপে না নিয়ে তিনি গেছেন শিধুলীতে চেক দিতে। তাই প্রশ্ন উঠেছিল, সাধারণ মানুষ তার কোনো নিকটজনকে পায়ে পিষে হত্যা করে অনুদান দিলে তিনি কি খুশি হবেন? তিনি শিধুলী যেতে চেয়ে যাননি, তাতে মানুষ আরো ুব্ধ হয়েছে। তিনি রাস্তাঘাটের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেননি। আধুনিক জামানায়, মোবাইল অপারেটরদের বললে ওই রাস্তায় সেদিন হানিফের খুনি গাড়ির যাত্রীরা ওই ঘটনার পরপর ফোনে যে কথাবার্তা বলেছেন- সেটা ইন্টারসেপ্ট করেও গাড়ির সন্ধান করা বা চিহ্নিত করা কোনো ব্যাপার ছিল না। হাঁটুর বুদ্ধি নিয়ে আর যা কিছু হোক ভালোভাবে রাষ্ট্র চালানো যায় না।
বলি হারি যাই মানবতার মনুষ্যত্বের। হানিফের সেই দানবীয় গাড়িতে একটা মানবও কি ছিল না, যারা ড্রাইভারকে তিরস্কার করতে পারে, গাড়ি থেকে নেমে থানায় জানাতে পারে? আমি আহ্বান জানাব ঘাতক গাড়ির যে যাত্রীরা ছিলেন তারা যেন বিবেকের আদেশে অমন খুনি চালকের পরিচয় দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করেন। তারা না করলেও এই জঘন্য অপরাধ চাপা থাকবে না। আল্লাহর চোখে কোনো কিছু চাপা থাকে না। তিনি সবই দেখেন এবং জানেন।

No comments

Powered by Blogger.