কৃষিখাত মজবুত করছেন গ্রামীণ নারী by শাহনাজ বেগম

দেশে ৭০ শতাংশের বেশি ভূমিহীন নারী কৃষিকাজে জড়িত। জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রামীণ নারীরা (গৃহিণী) ঘর ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন কৃষিকাজ, ব্যবসা বা চাকরিতে। নারীই এখন প্রতিদিন আয় করছেন গড়ে ১৫০-২০০ টাকা। প্রত্যেকের প্রত্যাশা, দিনকয়েক বাদে দৈনিক এ আয় দাঁড়াবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সারা বছরই নানা ধরনের কৃষিকাজে শ্রম দিয়ে উপার্জন করেন তারা। মজুরির ক্ষেত্রে পান পুরুষের অর্ধেক। এরপরও লড়ে চলেছে গ্রামীণ জনপদের সুবিধাবঞ্চিত নারীসমাজ। বৈষম্য ঘোচানের লড়াইয়ে আমরা তাদের শ্রদ্ধা জানাই।

নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে টিকে থাকার লড়াই যা বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চরিত্র। গত এক দশকের ব্যবধানে কৃষিকাজে প্রত্যক্ষভাবে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০০১ সালের জরিপ অনুযায়ী, কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আর সংস্থাটির সর্বশেষ ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশে।
তুলনামূলক নিম্নমজুরি কৃষিকাজে নারীদের যুক্ত হতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারীর মজুরি এখনও প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম। ২০১১ সালের জুলাই-আগস্টে একজন নারীর খাবার ছাড়া দৈনিক মজুরি ছিল ১৭৭ থেকে ১৭৯ এবং পুরুষের ছিল ২৩৬ থেকে ২৩৯ টাকা।
কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় বৈষম্য রয়েছে। এখনও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। তবে অগ্রগতি হয়েছে উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায়- বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাটে। এছাড়া কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোয় কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জেও কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রামীণ নারী ঘর ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন কৃষিকাজ, ব্যবসা বা চাকরিতে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচি কিংবা ক্ষুদ্র ঋণ ও কৃষিব্যবস্থায় পরিবর্তনশীলতা একে আরও ত্বরান্বিত করছে। বর্তমানে ৭০ শতাংশের বেশি ভূমিহীন নারী কৃষিকাজে জড়িত। পারিবারিক ভাঙন সমাজে স্বামী পরিত্যক্ত ও বিধবা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি ন্যূনতম প্রশিক্ষণহীন এক নারীকে কৃষিজীবী নারীতে পরিণত করছে প্রতিদিন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো দায়িত্বশীল পুরুষ ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চলের নারীপ্রধান ৫৮ শতাংশ পরিবার। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, বিধবার হার উত্তরবঙ্গে সর্বোচ্চ। ফলে এ অঞ্চলের জেলাগুলোয় নারীপ্রধান পরিবারের আধিক্য রয়েছে।
আর ৭২ শতাংশ পরিবারের নারীপ্রধানের বয়স ৩০ থেকে ৪৯ বছর। আবার পরিবারপ্রধান হওয়ার পর ৯০ শতাংশ নারীর পেশা পরিবর্তন হচ্ছে, যারা আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করছেন।
পেশা পরিবর্তনে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বসতবাড়িকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসা কিংবা কৃষিকাজ। উত্তরাঞ্চলের ৬৫ শতাংশ পরিবারপ্রধান নারী এখন এ দুটি খাতে কাজ করছেন। পরিবর্তিত গ্রামীণ অর্থনীতির কারণে কৃষিক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন বরাদ্দ রয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় ৪৬ শতাংশই ব্যয় করা হচ্ছে নারীর উন্নয়নে। কৃষি খাতের মোট বাজেটের ৩৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে একই কাজে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এসএম নাজমুল ইসলাম বলেন, কৃষি উন্নয়নে নারীর অবদান বিবেচনা করেই বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি বেসরকারি খাত থেকেও সচেতনতা বাড়ানোয় এ পরিবর্তন এসেছে। সামনের দিনগুলোয় কৃষি খাতে শ্রমিক সংকটে নারীই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ড. প্রতিমা পাল মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, যে কোনো খাতেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি মানেই অর্থনীতির চাকাকে সচল করা। আর নারীদের ক্ষেত্রে এ হার বৃদ্ধির অর্থই হল, নারীর সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। গ্রামে সেটা বেশি হচ্ছে বলেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসছে। তবে সার্বিকভাবে এ অবস্থা ধরে রাখতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক বাধাও দূর করতে হবে।
কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ শুধু বাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এ খাতের কর্মকাণ্ডে তাদের উৎপাদনশীলতাও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুযোগ তৈরির পাশাপাশি কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমবিভাজন নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়েছে। তুলনামূলক কম ভারি কাজ, বিশেষ করে ফসল বা খাদ্যশস্য কাটার পর তার বাছাই ও প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় নারীদের। তাছাড়া অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ধরে চলা কাজ, যেমন সেচকাজ পরিচালনা, ফসলের ক্ষেত তদারক করার কাজেও নারীর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। কৃষিকাজে অংশগ্রহণের কারণে গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারীর সংখ্যাও কমে আসছে।
তবে যে কারণেই পরিবারের নেতৃত্বে আসুক না কেন, পরিবারপ্রধান হওয়ায় নারীর আর্থিক সচ্ছলতা ক্রমেই বাড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে নারীর এ অংশগ্রহণ তার সক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। কয়েক বছর আগেও শুধু তালাকপ্রাপ্ত নারীকেই পরিবারপ্রধান হতে দেখা যেত। এতে সমাজে কেবল বঞ্চিত মানুষের সংখ্যাই বাড়ত। কিন্তু আজকে সে অবস্থা বদলেছে। এসব নারী প্রতিবন্ধকতা জয় করেই পরিবারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পরিবারপ্রধান হিসেবে নারীর সংখ্যা বাড়ার সুফল ভবিষ্যতে প্রভাব বিস্তার করবে সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি অর্থনীতিতে। এতে নারীর আত্মবিশ্বাস বাড়বে, বিবাহ-পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতন কমে আসবে এবং সমাজে তার অধিকার দৃঢ় হবে। এতে একটি ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি হয়ে নারীর স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে। আগামী দিনের অর্থনীতি-রাজনীতি ও সমাজ বিনির্মাণে কৃষিজীবী নারীর একটি সুস্পষ্ট অবস্থান তৈরি করবে। যা আজ করে নিয়েছে তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত কর্মজীবী মেয়েরা।
একনজরে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১০ সালে কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন ২ কোটি ৫৬ লাখ শ্রমিক। এর মধ্যে নারী প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ। এক দশক আগেও তা ছিল মাত্র ৩৮ লাখ। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ নারী। আবার গত এক দশকে কৃষিকাজে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ যে হারে বাড়ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী এক দশকের মধ্যেই তা পুরুষকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায়, বর্তমানে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ১৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর গ্রামীণ নারীর ৭১ শতাংশই এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত।

No comments

Powered by Blogger.