শহীদ মিনার শপথের পাদপীঠ এজমালি সম্পত্তি নয় by নূরে আলম সিদ্দিকী

মতিউর রহমান চৌধুরী ও নূরুল কবীরকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার বিষয়টি দেশের বাইরে থাকার কারণে আমার দৃষ্টিতে আসেনি। প্রতিনিয়তই অপরিশীলিত, অমার্জিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ও উদ্ধত আচরণের এই কার্যকলাপ প্রায়ই এমনভাবে প্রতিভাত হচ্ছে যে, একে দুঃশাসনেরই নামান্তর বলা যায়। এ সম্পর্কে নিবন্ধ লিখলে প্রতিদিনই কারও না কারও বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন, কারও না কারও স্পর্ধিত আচরণের বিরুদ্ধে কলম ধরতে হয়। মতিউর রহমান চৌধুরী এবং নূরুল কবীর সাহেবের বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে দু’টি কারণে। বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া ডেইলি স্টারের অফিস কক্ষে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সারওয়ারের সভাপতিত্বে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে তাতে অধিকার সচেতন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সত্তা এবং দেশের মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন দায়িত্বশীল প্রবীণ মানুষ হিসেবে আমার বিবেককে প্রতিবাদের জন্য উদ্দীপ্ত করে। ইতিমধ্যেই গণজাগরণ মঞ্চের যে অংশটির সভা ছিল তাদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাকে অবগত করেছেন, এটি তাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নয়, কে বা কারা এ ব্যানারটি টাঙিয়েছে হয়তো একটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির জন্য। এটি একটি বিতর্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যও হয়ে থাকতে পারে। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ে না গিয়ে আমি তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, তাদের দায়িত্বশীল নেতৃবর্গের বিষয়টি ব্যাখ্যা সহকারে বিবৃতি দিতে, তাতে কিছুটা হলেও বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হতো। আমি বা সব সম্পাদকমণ্ডলী থেকে শুরু করে সাংবাদিক সমাজ যতই ব্যথিত, মর্মাহত ও আশ্চর্যান্বিতই হই না কেন, সেটি তারা করেননি বিধায় ক্ষমতাসীনদের বিষয়টি তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনাটি উদঘাটন এবং দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদানের আশু প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যারা শহীদ মিনারকে তাদের এজমালি সম্পত্তি মনে করেন, সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবী (!)- তাদেরও নৈতিক দায়িত্ব ছিল এই স্পর্ধিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রতিবাদ করা ও নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে দোষী ব্যক্তির শাস্তি দাবি করা। এটি না করার কারণ কূপমণ্ডূকতা বা সরকারের প্রতি অন্ধ স্তুতির কারণে তাদের নিস্পৃহতা। শহীদ মিনারের সম্মান এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শহীদ মিনার বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষের পীঠস্থান। মাকে মা বলে ডাকার অধিকারবোধ থেকেই বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ। এটি জাতির চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার শপথ গ্রহণের পীঠস্থান। প্রথম প্রতিবাদের রক্তকে সম্মান জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি মানুষ শপথ নেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের। এখানেই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে “বাংলা প্রচলন সপ্তাহ” উদযাপন করার কারণে সব গাড়ির নাম্বারপ্লেট এবং দোকানের সাইনবোর্ড রাতারাতি বাংলায় রূপান্তরিত হয়। অনেক স্বর্ণালী সাফল্যের সোপান উত্তরণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে আমরা স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আন্দোলনে উত্তরণকালে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে আমিও বহুবার শহীদ মিনারে গিয়েছি; স্বাধীনতা অর্জনের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছি, গণতান্ত্রিক মননশীলতায় সবাইকে উজ্জীবিত করেছি, পরাধীনতার বিরুদ্ধে আমরা বজ্রনির্ঘোষ গর্জে উঠেছি। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যও শহীদ মিনারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে দেইনি বা দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার হীনম্মন্যতায় ভুগিনি। মতিউর রহমান চৌধুরী আমার কেবল অনুজপ্রতিমই নন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকও ছিলেন। কিন্তু ভ্রান্ত-বামের দৌরাত্ম্যে অনেকের মতো তিনিও বঙ্গবন্ধুর চেতনার উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের (কমিউনিস্ট লীগ) মূল স্রোতধারা থেকে উচ্ছিষ্টের মতো নিক্ষিপ্ত। আরেকজন নূরুল কবীর- তিনিও প্রথিতযশা সাংবাদিক, নিউএজের সম্পাদক এবং টকশোর একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। এরা দু’জনেই আমার অনুজপ্রতিম। অনেক টকশোতে আমি এদের সঙ্গে কথোপকথন করেছি এবং হৃদয়ের সিংহাসনে বিবেকের জাগ্রত দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের তাগিদেই বিমুগ্ধচিত্তে অনুধাবন করেছি- এরা দলকানা নন। তোষামোদি, মোসাহেবি, চাটুকারিতার বেড়াজালে তারা মুক্তবুদ্ধিকে কখনও বন্দি করেননি। সত্যের খাতিরে অনেক সময় ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করেছেন। তাদের ব্যবহৃত ভাষাটি শক্ত হলেও কখনও হিংসা বা বিদ্বেষপূর্ণ নয়। সৃষ্টিশীল বিরোধিতা ক্ষমতাসীনদের বিবেককে উন্মোচিত ও নিষ্কলুষিত করার একটা অনিবার্য প্রয়াস। আমিও এখনই বিশ্বাস করতে চাই, সমালোচনা গণতন্ত্রের অনিবার্য শর্ত বলেই টকশো’র বিরোধিতাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ না করে ক্ষমতাসীনরা অবশ্যই আমলে নেবেন, তদন্ত করবেন এবং তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেবেন। নইলে অপবাদের দায়ভার অনর্থক তাদেরকে বইতে হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.