কথায় কথায় মামলা by গোলাম রব্বানী

কার বিরুদ্ধে কয়টি : খালেদা জিয়া ৬টি ; মির্জা ফখরুল ৪৭টি ; খন্দকার মোশাররফ ২০টি ;ব্যারিস্টার মওদুদ ১৮টি ; হান্নান শাহ ১৬টি ; রফিকুল ইসলাম মিয়া ২৩টি ; মির্জা আব্বাস ৪১টি
কথায় কথায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। শীর্ষ নেতারাই এ ক্ষেত্রে মূল টার্গেট। যার যখন খুশি মামলা ঠুকে দিচ্ছেন থানায় কিংবা আদালতে। সরকারি দলের নেতাকর্মী ও পুলিশ বাদি হচ্ছেন এসব মামলায়। এতে বাড়ছে হয়রানি। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে ক্রমান্বয়ে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বহির্বিশ্বে একটি সন্ত্রাসী শক্তি হিসেবে বিরোধীদের দেখাতে চাইছে সরকার। সে জন্যই তারা বিরোধী শক্তির কথা বলাসহ মৌলিক অধিকারগুলো সঙ্কুচিত করে আনছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গত ২১ অক্টোবর একটি মামলা করা হয়। মামলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি সরাসরি দায়ের করা হয় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। মামলার বাদি সরকার সমর্থক সংগঠন ‘জননেত্রী পরিষদ’র সভাপতি এ বি সিদ্দিকী। গত ১৪ অক্টোবর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক অনুষ্ঠানে দেয়া বেগম জিয়ার বক্তব্য বিষয়ে অভিযোগ আনেন তিনি। মহানগর হাকিম বাদির বক্তব্য শুনে যথাযথ সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর অভিযোগ তদন্ত করে ১৯ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে শাহবাগ থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। এ ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে পাঁচটি দুর্নীতি মামলা রয়েছে। এই পাঁচটির মধ্যে দু’টি মামলার বিচারকাজ জোরেসোরে শুরু হয়েছে। মামলা দু’টি বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
বেগম জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, গত ১৪ অক্টোবর বেগম জিয়া কোনো ধর্মকে আঘাত করে কোনো বক্তব্য দেননি। তিনি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছেন। আওয়ামী লীগ কোনো ধর্মের মর্যাদাই রক্ষা করতে পারছে না। ব্যারিস্টার খোকন আরো বলেন, দেশে একটা অনির্বাচিত ও বিতর্কিত সরকার বিদ্যমান। তারা তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখার কৌশল হিসেবে এসব মামলা দিচ্ছে।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গত ১৯ অক্টোবর একটি মামলা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূর বাদির জবানবন্দী শোনেন। পরে বিচারক অভিযোগটি সরাসরি আমলে না নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে অভিযোগ তদন্ত করে ২৬ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পাকবন্ধু’ বলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এ ছাড়া আছে ১৪-১৫টি মামলা।
একটি মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে গত ২০ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ জহুরুল হক অভিযোগ গঠন করে আগামী ২৩ নভেম্বর স্যা গ্রহণের দিন ধার্য করেন। গত বছর মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশে হামলার ঘটনায় পরদিন সংবাদ সম্মেলনে তিনি বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেবাশীষ বিশ্বাস বাদি হয়ে গত ৭ মে মামলাটি করেন। বিএনপির এই নেতার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে।
এ দিকে গত শনিবার বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ ৬১ জন নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর লালমাটিয়ার আলালের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, হরতালকে সামনে রেখে নাশকতার পরিকল্পনা হচ্ছিলÑ এমন গোপন খবরের পরিপ্রেেিত তাদের আটক করা হয়। তবে বিএনপি নেতারা দাবি করেন, আলাল তার লালমাটিয়া নিউ কলোনি মাঠের পশ্চিম পাশের বাসার নিচে সাংগঠনিক বৈঠক করছিলেন। আটকের পর ওই দিনই রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ওসি আজিজুল হক সাংবাদিকদের বলেন, লালমাটিয়ার ওই বাসার আন্ডার গ্রাউন্ডে তারা বৈঠক করছিলেন। এ সময় তাদের আটক করে পুলিশ।
এ দিকে আটকের পর তাদের মধ্য থেকে আলালসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ড চায় পুলিশ। পরে আদালত তাদের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ছাড়াও বিএনপি নেতা আলালের বিরুদ্ধে পুলিশ ও সরকারি দলের নেতাকর্মীর দায়ের করা শতাধিক মামলা রয়েছে।
এভাবে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে একের পর এক নতুন মামলা। এ ছাড়া পুরনো মামলাগুলোও সচল হচ্ছে একের পর এক। গত ৫ জানুয়ারির আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি জোটের আন্দোলনের সময় তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, বোমা হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে পুলিশ অসংখ্য মামলা করে। সেসব মামলায় চার্জশিট দাখিল ও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে দায়ের হওয়া এসব মামলায় আদালতে ধারাবাহিকভাবে অভিযোগপত্র জমা দিচ্ছে পুলিশ। এসবের ওপর ভিত্তি করে শুরু হচ্ছে বিচারকাজ।
দলটির স্থায়ী কমিটির ১৮ জন সদস্যের মধ্যে দু’জন বাদে সবার বিরুদ্ধেই রয়েছে মামলা। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী দীর্ঘদিন কারাগারে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে দণ্ডিত করেছেন ট্রাইব্যুনাল। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের হওয়া এক মামলায় কয়েক মাস ধরে জেলে। একাধিকবার জামিন নিয়েও মুক্তি মেলেনি তার। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২০টির বেশি। ১৮ মামলার আসামি স্থায়ী কমিটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে একটি মামলায় চার্জশিট দাখিল করেছে দুদক। স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ স ম হান্নান শাহ ১৬ মামলার আসামি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে আছে ২৩ মামলা, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে রয়েছে ৪১টি মামলা। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৪৭টি। এ ছাড়া বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে শতাধিক মামলা।
এ  ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) সম্প্রতি মামলা নিয়ে বেশ সচল দেখা গেছে। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বিরোধীদলের বেশ কয়েকজন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাসংক্রান্ত একটি আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য আগামী ২৭ নভেম্বর তারিখ ধার্য করেন চেম্বার বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। কিন্তু পরে এই লিভ টু আপিল আবেদনের শুনানি এগিয়ে আনতে আদালতে আবেদন করে দুদক। তাদের আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আগামী ৬ নভেম্বর লিভ টু আপিলের শুনানির দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ যা করে তা সোজাসুজি করে না। তারা কৌশলে কাজ হাসিল করে। মানুষের কথা বলার অধিকার সঙ্কুচিত করে আনছে। তারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কথায় কথায় মামলা দিচ্ছে। তাহলে আমরা যারা সাধারণ নাগরিক তাদের নিরাপত্তা কোথায়? তিনি আরো বলেন, মামলা দায়েরের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারা এই জোটকে একটি সন্ত্রাসী শক্তি হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। সন্ত্রাস কথাটি শুনলে সারা বিশ্বই চমকে উঠে। আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে সফল হতে চেষ্টা চালাচ্ছে। সে জন্য তারা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নির্যাতন করে যাবে। মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়া।

No comments

Powered by Blogger.