অতীত স্মরণ করিয়ে দিলেন প্রণব মুখার্জি by সিরাজুস সালেকিন

ভারত সফরে দেশটির প্রথম বাঙালি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জিকে কাছে পেয়েছিল বাংলাদেশের ১০০ তরুণ প্রতিনিধি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অতীতকে খুঁজে পেলো তরুণরা। আর প্রণব মুখার্জির বক্তব্যে ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে নিজেদের অধিকার খুঁজে পায় বাংলাদেশ। ভারতের প্রেসিডেন্ট বললেন, আইনগতভাবেই ভারতের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে বাংলাদেশের অধিকার রয়েছে। অধিকার রয়েছে ভারতের ১৩তম প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির ওপরও। মূলত বাংলাদেশের তরুণ প্রতিনিধি দলের সফর পূর্ণতা পায় প্রণব মুখার্জির আতিথেয়তার মাধ্যমে। তাই ১৮ই অক্টোবর শনিবার দিনটি ছিল বাংলাদেশের তরুণদের জীবনে একটি স্বরণীয় দিন। এদিন সকাল সাড়ে আটটায় রাষ্ট্রপতি ভবনে হাজির হয় বাংলাদেশের ১০০ তরুণ। প্রেসিডেন্টের গার্ডের নান্দনিক কুচকাওয়াজ উপভোগ করে তরুণরা। এরপর ১০টায় রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করে প্রতিনিধি দল। এই ভবনটি নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছিল ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের পর। বৃটিশ শাসনামলে এটি ছিল ভাইসরয় হাউজ। ১৯৫০ সালে রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের প্রথম প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় এর নাম দেন রাষ্ট্রপতি ভবন। প্রায় ঘণ্টা খানেক রাষ্ট্রপতি ভবন ঘুরে দেখার পর তরুণ প্রতিনিধি দলকে নিয়ে আসা হয় দরবার হলে। সাড়ে ১২টায় প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি দরবার হলে প্রবেশ করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব রাজিব গুপ্ত এবং ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের কাউন্সিলর (পলিটিক্যাল ও ইনফরমেশন) সুজিত ঘোষ। অনুষ্ঠানের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী। এরপর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে অনুভূতি ব্যক্ত করেন পলাশ মাহবুব ও কাজী শাহরিন। এরপর বক্তব্য রাখতে ডায়াসে আসেন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের তরুণদের পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তার বক্তব্য বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।  প্রণব মুখার্জি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্ম। যে ভবনে আমি আপনাদের বরণ করেছি আপনারা আইনগতভাবে সেটা নিজেদের অংশ দাবি করতে পারেন। এই দরবার হলের স্তম্ভ, গম্বুজ সবকিছুর সঙ্গে দুই দেশের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এ ইতিহাস আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। এ ইতিহাস আপনাদের, আমার ও উপমহাদেশের চার শত মিলিয়ন মানুষের পূর্বপুরুষের ইতিহাস। এটা সময়ের দাবি ছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর ১৯০ বছর এই দেশ শাসিত হয়েছে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড ডুবি পোহালে শর্বরি’। এই শাসন শুধু উপমহাদেশে নয়, এর আশপাশের অঞ্চলগুলোতে বিস্তার লাভ করে। আপনাদের এই এই সুন্দর হলে আমন্ত্রণ জানাতে পেরে আমি গর্বিত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আমি তৃতীয়বারের মতো তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি। আপনারা শুধু এই ভবনের ওপর দাবি নয়, ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতির ওপরও দাবি রাখেন। আপনাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা নির্বাচনের পর আমি বুঝতে পারি। কিছু বাংলা সংবাদপত্র একটি খবর প্রকাশ করেছিল যে- বাংলাদেশের জামাই ভারতের প্রেসিডেন্ট। অবশ্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে আমার শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। পরে ২০১৩ সালে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের। বন্দুক হাতে মুক্তিবাহিনীর অংশ হিসেবে নয়। বরং সহায়তা দানের মাধ্যমে। এই উপমহাদেশ থেকে আমি প্রথম ১৯৭১ সালের ১৫ই জুন ভারতের পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করি মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে এ সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। যখন ৩রা ডিসেম্বর জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের সৈন্যরা যৌথভাবে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করে তখন আসল স্বীকৃতি আসতে শুরু করে। আমার বক্তব্যে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, ভোগান্তি পার্লামেন্টের নজরে এসেছে। আপনারা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন রক্ত ও ঘাম দিয়ে তা সংরক্ষণ করতে হবে। আপনাদের গণতন্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে, মানবাধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। নিজেদের রক্ষা করতে হবে ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগ থেকে। তরুণদের সংবেদনশীল মন ও শিক্ষালাভের সুযোগ থাকার কারণে নেতৃত্ব দিতে হবে মিলিয়ন মানুষের। এখন ১৫০০ মিলিয়ন মানুষ। স্বাধীনতার সময় ছিল ৭৫০ মিলিয়ন। জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সমস্যা বেড়েছে বিস্ময়করভাবে। প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অথনৈতিকভাবে যুক্তিসংগত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সাধুবাদ জানাই। আমি আশ্বস্ত করছি, বাংলাদেশের জন্য ভারত তাদের সহায়তার হাত প্রসারিত রাখবে। বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও উন্নতির অগ্রযাত্রায় পাশে থাকবে। আমাদের বন্ধন রক্ত ও ত্যাগের বাঁধনে বাঁধা। হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাসের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, শুধু মুক্তিবাহিনী নয়। অসংখ্য ভারতীয় সৈন্য জীবন দিয়েছেন, যা চিহ্নিত হয়নি। এটা জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে তারা সমাহিত আছেন। বাংলা মাকে ভোলা যায় না। পূর্ণিমার রাতে যখন মিষ্টি বাতাস তাদের চিহ্নহীন কবরের ওপর দিয়ে বয়ে যায় তখন বাংলা মা ফিসফিস করে বলে আমরা তোমাদের ভুলব না। আমরা তোমাদের স্মরণ করি। এটাই বাঁধন যা দু’দেশের মধ্যে স্থাপন হয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব সমাপনী বক্তব্য দেন। আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায় নেয় তরুণ প্রতিনিধি দল। এর আগে ১৬ই অক্টোবর সকালে মুম্বই থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশের তরুণ প্রতিনিধি দল নয়া দিল্লি পৌঁছে। অশোকা রোডের ফোর স্টার হোটেল রয়েল প্লাজা হয় নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশের তরুণদের ঠিকানা। দুপুরের খাবার শেষ করে বাসে করে নির্মাণ বিহারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। এই যাত্রায় তরুণদের সঙ্গে যুক্ত হন ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কাউন্সিলর সুজিত ঘোষ। বাংলাদেশী তরুণদের নতুন এক অভিজ্ঞতা নেয়ার সুযোগ দেন তিনি। বাসের বদলে মেট্রো রেলে করে নির্মাণ বিহার যাওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। দিল্লিজুড়ে মোট ১৩৭টি মেট্রো রেলস্টেশন। ১৮৯ কিলোমিটারের মেট্রোর রয়েছে সাতটি অপারেশনাল লাইন। প্রতি ৩ থেকে ৪ মিনিট পরপর মেট্রো স্টেশনে আসে। এক মিনিটের মধ্যে যাত্রী ওঠানামা করে। এরপর আবার স্টেশন ছেড়ে যায়। মেট্রোতে ভ্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণরা আধুনিক দিল্লি কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সে ধারণা লাভ করে। মেট্রো থেকে নেমে সরাসরি স্কুপ মিনারে নেহেরু যুব কেন্দ্র সংগঠনের (এনওয়াইকেএস) প্রধান কার্যালয়ে। এনওয়াইকেএস ভারতের যুব সংগঠনগুলোর প্লাটফরম। জাতি গঠনে যুবকদের অন্তর্ভুক্ত ও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭২ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সংগঠনটির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় হয় বাংলাদেশী তরুণদের। পরদিন শুক্রবার সকালে রাজঘাট হয়ে দিল্লির রেডফোর্টে ঘুরতে যায় বাংলাদেশের তরুণরা। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে দাহ করা হয়েছিল এই রাজঘাটে। দিল্লিতে রাজধানী স্থাপনের পর সম্রাট শাহজাহান এই রেডফোর্ট নির্মাণ করেছিলেন। এটি নির্মাণ করা হয়েছে আগ্রার লালকেল্লার আঙ্গিকেই। মুঘল শাসকদের বিলাসিতা আর আভিজাত্যের নিদর্শন মেলে এই কেল্লা থেকে। রেডফোর্ট ঘুরে দেখার পর পরবর্তী গন্তব্য ইন্ডিয়া গেট। সেখানে ফটোসেশন শেষে রেল জাদুঘর। কিন্তু জাদুঘরে বৈদ্যুতিক সংস্কার কাজ চলার কারণে প্রবেশের সুযোগ ছিল না। এরপরে যাত্রা শুরু হয় কুতুব মিনারের উদ্দেশে। কুতুব মিনার বিশ্বের সর্বোচ্চ ইট নির্মিত মিনার। এই বিজয়স্তম্ভটি দিল্লি থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর আশপাশে অনেকগুলো প্রাচীন, মধ্যযুগীয় স্থাপনা ও ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সব মিলিয়ে কুতুব কমপ্লেক্স বলা হয়ে থাকে। কুতুব মিনার থেকে হোটেলে ফেরে তরুণ প্রতিনিধি দলের গাড়িবহর। রাতে অশোকা হোটেলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশভোজ আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের প্রতিভাবান প্রতিনিধি দলের একের পর এক পরিবেশনা আমন্ত্রিত অতিথিদের আনন্দ দেয়। অন্যদিকে ভারতের ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গান পরিবেশন করেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা তরুণ শিল্পীরা।
>> বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের পক্ষে কাজী শাহরিন ও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কাউন্সিলর (পলিটিক্যাল ও ইনফরমেশন) সুজিত ঘোষ প্রেসিডেন্টের হাতে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দেন

No comments

Powered by Blogger.