কারিগরি জ্ঞান অর্জনের নামে প্রমোদভ্রমণ! by সুমন্ত চক্রবর্ত্তী

খুলনায় পানি শোধনাগার কেন্দ্র নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা ও পরবর্তী সময়ে এটি পরিচালনা-সংক্রান্ত ‘জ্ঞান অর্জনের’ জন্য থাইল্যান্ডে গেছেন খুলনা ওয়াসা বোর্ডের ১২ জন সদস্য। এটি মূলত কারিগরি সফর। কিন্তু সফরে যাওয়া ১২ জনের মধ্যে সাতজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। কারিগরি এই সফরে বোর্ড সদস্য ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করায় সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, খুলনা নগরবাসীর জন্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে খুলনা ওয়াসা। কিন্তু ছয় বছর মেয়াদি ওই প্রকল্পের মাত্র ২০ শতাংশের মতো কাজ হয়েছে গত তিন বছরে। কাজের এই ধীরগতিতে নগরবাসীর পাশাপাশি ওয়াসা বোর্ডের সদস্যরাও ক্ষুব্ধ ওয়াসা কর্তৃপক্ষের ওপর। তাই বোর্ড সদস্যদের ক্ষোভ প্রশমন করতে তাঁদের জন্য প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ধরনের ভ্রমণে ক্ষোভ প্রকাশ করে খুলনা-২ (সদর) আসনের সাংসদ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়াসার ওই প্রকল্পের কাজ গত তিন বছরে তেমন এগোয়নি। নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা একেবারে শেষ হয়েছে। কাজের বেলায় খবর নেই, বোর্ড সদস্যরা বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
বোর্ড সদস্যদের এই সফরের জন্য প্রকল্পের কোন অংশ থেকে কত টাকা ব্যয়ে হচ্ছে, সে ব্যাপারে প্রকল্প অফিস ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিছু জানাতে পারেনি। তারা বলছে, এই সফরে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)।
এ বিষয়ে এডিবির প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট সুধীর কুমার ঘোষ বলেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না। ঢাকা অফিস সব জানে।
তবে বোর্ড সদস্যদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টার অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক খান সেলিম আহম্মদ। তা হলে কারিগরি এই সফরে রাজনৈতিক নেতারা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোর্ড সদস্যরা হয়তো থাইল্যান্ডের পানি শোধনাগার কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখতে চেয়েছেন, তাই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
ওই সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের সফরে গত বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ডে গেছেন ওয়াসা বোর্ডের ১২ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাত নেতা হলেন: ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাজী আমিনুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও বিএমএর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি চিকিৎসক শেখ বাহারুল আলম, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আনিসুর রহমান ওরফে পপলু, মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মকবুল হোসেন ওরফে মিন্টু, কেসিসির কাউন্সিলর ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক শেখ আমেনা হালিম বেবী।
এ ছাড়া সফরে যাওয়া অন্য বোর্ড সদস্যরা হলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক বেগম জুয়েনা আজিজ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা খন্দকার মোরাদ হোসেন, খুলনা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মুহাম্মদ আলমগীর, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ওরফে তাপন এবং খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ।
গত আগস্ট মাস থেকে বিদেশ সফরের প্রস্তুতি চললেও বিষয়টি গোপন রাখা হয়।
খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘খুলনা ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট’-এর কাজ শুরু হয় ২০১১ সালের জুলাইয়ে। বাংলাদেশ সরকার, এডিবি ও জাইকা যৌথভাবে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। এর মধ্যে সরকার ৭৫০ কোটি, এডিবি ৫০০ কোটি ও জাইকা ১২০০ কোটি টাকা দিচ্ছে। গত তিন বছরে প্রকল্পের ২০ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি। এই প্রকল্পের আওতায় রূপসার সামন্তসেনা এলাকায় দৈনিক ১১ কোটি লিটার উৎপাদনক্ষমতার একটি পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। এই শোধনাগার নির্মাণের জন্য প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
এ ছাড়া বর্তমানে নগরবাসীর চাহিদার অর্ধেক পানিও সরবরাহ করতে পারে না ওয়াসা। সময়মতো পানি সরবরাহ না করেই বিল আদায়ে অভিযান এবং পানির মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে নগরবাসীর পাশাপাশি বোর্ড সদস্যরাও ক্ষুব্ধ ছিলেন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের কারিগরি বিষয় দেখতে যাওয়ার কথা প্রকৌশলীদের। সেখানে রাজনৈতিক নেতারা কেন গেলেন, বুঝতে পারছি না। ২০০৮ সালে খুলনা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ যাবৎ বোর্ডের সব সদস্যের একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার নজির এই প্রথম। তাঁদের ম্যানেজ করতে এই সফরের আয়োজন করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
তবে খুলনা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ সফর তো ওয়াসার পক্ষ থেকে নয়। বোর্ড সদস্যরা যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে, তাই এডিবি তাদের নিয়ে গেছে। এই সফরে সম্পূর্ণ অর্থ দিচ্ছে এডিবি। সেহেতু আমরা জানি না কত টাকা ব্যয় হচ্ছে।’

No comments

Powered by Blogger.