তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার by মিজানুর রহমান খান

বিএনপি সরকারের আমলে তৈরি করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মানহানি ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা–বিষয়ক ৫৭ ধারার আওতায় সারা দেশে মামলার সংখ্যা সংক্রামক ব্যাধির মতো দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। এই ৫৭ ধারা কি সেই ৫৪ ধারা হতে চলেছে? সন্দেহের বশে পরোয়ানা ছাড়াই পাইকারি গ্রেপ্তারের হাতিয়ার হিসেবে দণ্ডবিধির ৫৪ ধারা কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। অবশ্য সাইবার অপরাধের ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করা যাবে না। একে কঠোরহস্তেই দমন করতে হবে। কিন্তু আইনের অস্পষ্টতার কারণে এর অপব্যবহারের আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি। টেলিফোনে ২২ অক্টোবর আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে কথা হলো। তাঁকে জানালাম, ভারতের ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৭ ও ৬৬ক ধারার সঙ্গে আমাদের বিতর্কিত ৫৭ ধারার মিল পাবেন। এটা ধারণা করা যায় যে ভারতীয় আইনের ৬৭ ধারা তরজমা করতে গিয়ে ২০০৬ সালের খসড়া প্রস্তুতকারীরা দুরভিসন্ধির আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই ৬৭ ধারা কেবল অশ্লীলতাবিরোধী। অথচ তা নকল করতে গিয়ে বিএনপির সাংসদেরা তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অশ্লীলতার সঙ্গে মানহানি, নীতিভ্রষ্টতা, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অন্তর্ভুক্ত করেন। সবচেয়ে অভিনব ছিল মিথ্যাকে শাস্তিযোগ্য করা। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের কথায়, ২০০ বছর আগেই মিথ্যার জন্য শাস্তির বিধান রহিত হয়ে গেছে। আদর্শলিপি বইয়ে লেখা ছিল মিথ্যা বলা মহাপাপ। এখন পাঠ্যপুস্তকে লেখা উচিত মিথ্যা বললে ১৪ বছর কারাবাস।

‘প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মুঠোফোনে কটূক্তি, বাবা-ছেলে গ্রেপ্তার’ শীর্ষক একটি খবর ১৯ অক্টোবর প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। ১৩ বছরের সিজান সম্ভবত এই আইনের প্রথম কিশোর অভিযুক্ত। ২৪ অক্টোবরে মুঠোফোনে বগুড়ার কাহালু থানার ওসি সমিত কুমার কুন্ডু আমাকে জানালেন, মুঠোফোনটি শুকুর আলীর। তিনি হতদরিদ্র। বাদাম ফেরি করেন। ছেলেটি শীতলাই দাখিল মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সে তার বাবার মুঠোফোনটি প্রকাশ্যে (পাবলিক প্লেসে) নয়, বাড়িতে বসে বাজাচ্ছিল। সেটি একটি ভিডিও। যাতে বিড়ালের ছবি আছে। কোনো মানুষের ছবি নেই। ওসি আরও নিশ্চিত করেন, কটূক্তিগুলোও কোনো মানুষের কণ্ঠে শোনা যায়নি। তাঁর দাবি, ‘এটা যান্ত্রিক, ডিজিটাল কণ্ঠস্বর।’ তিন কিলোমিটার দূরবর্তী থানা থেকে খবর পেয়ে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। আজ ২৭ অক্টোবর বাবা-ছেলের রিমান্ড শুনানি হবে। এই ‘অপরাধের’ প্রতিকার অন্য আইনে ছিল। মানহানির সাজা সর্বোচ্চ দুই বছর। দেশে এখন একই অপরাধের দুই রকম সাজা। আপনি যদি বিষয়টি ‘ইলেকট্রনিক’ মাধ্যমে ফেলতে পারেন, তাহলে কাউকে ১৪ বছর জেল খাটাতে পারবেন। দুই বছরের সাজা হবে ১৪ বছর।
প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মর্যাদা রক্ষার জন্য তো ওই আইনে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। কাহালুর ওসি নিজেই আসামি ধরতে গেছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, দুই দিন পরে যখন কেউ কাউকে ৫৭ ধারায় ফাঁসাতে চাইবে, তখন কি তিনি এভাবেই ছুটবেন? ওসি বললেন, ‘এখানে তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত।’ তাঁর কাছ থেকেই শুনলাম, নারায়ণগঞ্জে এই ৫৭ ধারায় একই ধরনের অভিযোগে নতুন গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। এটা আশার বিষয় কি না জানি না, তবে শুনলাম আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এই আইনের বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। যদিও তারা আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়ে গত বছরেই বিএনপির সৃষ্ট কালাকানুনকে আরও তীক্ষ্ণÿ হুলসম্পন্ন করেছিল। এই আইনে অপরাধকে অজামিনযোগ্য, ন্যূনতম শাস্তি ৭ ও সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরে উন্নীত এবং জরিমানার অঙ্ক এক কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এর পরও আইনমন্ত্রীর মন্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি জানালেন যে আইনটি তিনি নিজেই খতিয়ে দেখছেন।
বিএনপি প্রতিপক্ষের জন্য গর্ত খুঁড়েছিল। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার এর প্রথম শিকার হলেন। এই আইনে প্রথম পেশাদার রাজনীতিক হিসেবে তাঁর বিচার শুরু হবে ৩০ নভেম্বর। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এটা কিন্তু দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় বিচার্য ছিল। সেখানে যেহেতু মাত্র দুই বছর জেল, তাই ওই মামলার বাদী (স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা) হয়তো সেদিকে যাননি। তবে আপাতত অধিকতর উদ্বেগজনক হলো, এটা প্রধানমন্ত্রীর অবমাননা আইনে পরিণত হচ্ছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের প্রথম সাজাও ঘটেছে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে। খুলনার এক সংখ্যালঘু তরুণের প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর জন্য ‘অবমাননাকর’ গান তৈরি ও তা প্রচারের জন্য সাত বছর জেল হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এখন পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে তা প্রধানত প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননাকেন্দ্রিক। কিন্তু এই সীমার মধ্যে বেশি দিন এটা থাকবে না। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েলে আইনটির অপব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পেতে পারে। সব খবর গণমাধ্যমে দ্রুত আসবে বলেও মনে হয় না। প্রচলিত অন্য আইনে একই অপরাধের বিচার করা গেলেও পুলিশ প্রশাসন এখন সুযোগ পেলেই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা ঠোকার প্রবণতা দেখাবে। এর অজামিনযোগ্যতা, অন্তত সাত বছর জেলখাটা, এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান—ভয় দেখানোর জন্য সবই উপাদেয়।
প্রতিপক্ষ বা শত্রু ঘায়েলে এই আইনের আরেকটি অপপ্রয়োগের উদাহরণ দিই। গত ৩ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় ইমরান হোসেন আরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর এক আত্মীয় আমাকে বলেন, আরিফের বিরুদ্ধে এর আগে যারা চারটি মামলা করে পেরে ওঠেনি, তারাই এবার তাকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ফেলেছে। ফেসবুকে আরিফ লিখেছেন, ‘যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বলা হয়, তাহলে শেখ হাসিনা আমার বোন ও তাঁর ছেলে আমার ভাগনে।’ তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, এ ধরনের মন্তব্য শাস্তিযোগ্য, তাহলে তাঁকে তিরস্কার বা সামান্য জরিমানা করা যেতে পারে। কিন্তু আইন অনুযায়ী এখন এই ৩৩ বছরের যুবককে ১৪ বছর জেল বা এক কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে। বাস্তবে আরিফের ক্ষেত্রে যদি তা না–ও হয়, তার পরও এ রকম একটি মধ্যযুগীয় আইন কেন আমাদের মাথার ওপর ঝুলবে? শুনলাম, স্থানীয় প্রশাসনের নানা অনিয়ম তিনি ফেসবুকে প্রকাশ করতেন। অভিযোগ উঠেছে, কুষ্টিয়া শহর যুবলীগের এক নেতা প্রশাসনের ইঙ্গিতে আরিফের বিরুদ্ধে এই মামলা দিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মন্তব্য বিষয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও কিন্তু অভিযুক্ত হচ্ছেন। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়া সফররত একজন শিক্ষক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করায় হাইকোর্ট তাঁকে তলব করেন। তিনি তা অগ্রাহ্য করলে তাঁকে ছয় মাস দণ্ড দেওয়া হয়। গত ১৯ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক উপপরিচালক শামসুজ্জোহাকে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্যের জন্য গ্রেপ্তার করে। গত ৫ সেপ্টেম্বর নিউ এজ রিপোর্ট বলেছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এক ডজনের বেশি মামলা চলছে সারা দেশে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে শেখ হাসিনা সম্পর্কে ‘অশ্লীল ও অবমাননাকর’ উক্তির দায়ে ঢাকার দায়রা আদালত বুয়েটের সাবেক শিক্ষক হাফিজুর রহমান রানাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। তবে এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ভারতেও কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও তার অপপ্রয়োগ নিয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার। গত বছর সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ আরও দুজন নেতাকে নিয়ে ফেসবুকে কেরিকেচার করেছিলেন সঞ্জয় চৌধুরী। সে জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে রাজনৈতিক কার্টুন এঁকেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। এটা মাইলফলক ঘটনাই বটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ক ধারা, যেটা আমাদের ওই ৫৭ ধারার সঙ্গে তুলনীয়, তার আওতায় গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। এরপর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মানবাধিকার কমিশন যেটা করল সেটা আমাদের ‘স্বাধীন’ মানবাধিকার কমিশনের জন্য অনুসরণীয়। তারা এই ঘটনায় ‘অতি উৎসাহী’ দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের এবং অধ্যাপক মহাপাত্র ও তাঁর এক প্রতিবেশী, যাকে আটক করা হয়েছিল, তঁাদের ৫০ হাজার রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করে।
এখন যেটা সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার সেটা হলো, অতি উৎসাহীরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ‘লেসে মাজেস্টি’ জাতীয় একটা কিছু ইতিমধ্যে চালু করে দিয়েছে কি না। লেসে মাজেস্টি ফরাসি শব্দ। এর অর্থ হলো ‘রাজা বা রাষ্ট্রের মর্যাদার হানি ঘটানো।’ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অনেক রাজতন্ত্রে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এ জন্য সর্বত্র লঘুদণ্ড। থাইল্যান্ডে একসময় এই আইনে মামলা হু হু করে বাড়তে থাকলে থাই রাজা ভূমিবল একবার তাঁর জন্মদিনে বলেছিলেন, অবশ্যই আমার সমালোচনা করা যাবে। এমনকি আরও বলেছিলেন, ‘কিং ক্যান ডু রং।’
আশা করব, আওয়ামী লীগ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ছদ্মাবরণে দেশে ‘লেসে মাজেস্টি’ ধরনের রাজতন্ত্রের আইন চালু হতে দেবে না। ভারতে এর অপপ্রয়োগ বাড়ার পর সুপ্রিম কোর্ট রুল দিলে সরকার এ ব্যাপারে সারা দেশে একটি পরিপত্র জারির কথা জানায়। ভারত সরকারের সেই পরিপত্র অনুযায়ী গ্রাম ও শহরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করতে হলে ডিএসপি এবং মহানগরে মামলা দায়েরে আইজিপির অনুমোদন লাগবে। এ রকম একটা রক্ষাকবচ আমাদেরও দরকার।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.