কোথায় আছেন এমপিরা by তৌফিকুল ইসলাম বাবর

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি) আসনে জয়লাভের পরদিনই চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু। গত শুক্রবার পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামে পা রাখেননি। তাই নতুন এমপির দেখা পাননি এলাকার লোকজন। যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি সোলায়মান আলম শেঠ জানান, দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে ঢাকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। নির্বাচনী এলাকায় তার কখন আগমন ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৫ সীতাকুণ্ড আসনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত এমপি দিদারুল আলম নির্বাচনের পরদিন থেকে বৃহস্পতিবার শপথ গ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত সময় কাটান নিজ নির্বাচনী এলাকায়। নির্বাচনের পরদিন সোমবার সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা এবং মঙ্গলবার বড়ূয়াপাড়ায় গিয়ে হামলার শিকার সংখ্যালঘু পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। বুধবার ভাটিয়ারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতির ক্ষতিগ্রস্ত ঘর পরিদর্শনে যান। এভাবেই এলাকায় নিজের উপস্থিতি জানান দেন সিটি মেয়র মনজুরের ভাতিজা দিদারুল আলম এমপি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচিত হয়ে এলাকায় যাননি চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের নবনির্বাচিত অনেক এমপি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় নিশ্চিত হওয়ার পর এলাকামুখো হননি কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ এলাকায় গেলেও তা ছিল নামমাত্র। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন কয়েকজন এমপি। নির্বাচনের পর নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করেন তারা। দলের নেতাকর্মী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি তারা হামলার শিকার সংখ্যালঘু লোকজনের খোঁজ-খবর নেন। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে সাতটিতে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন সাতজন।
চট্টগ্রাম-৬ রাউজান আসনে এবার একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। গত নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেছিলেন। এবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার একদিন আগে তিনি গ্রামের বাড়ি রাউজান গিয়ে মুরবি্বদের কবর জেয়ারত করে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। পরদিন শহরে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ঢাকায় গেলেও শুক্রবার পর্যন্ত রাউজানে পা দেননি তিনি।
চট্টগ্রাম-৪ হাটহাজারী আসনের সাংসদ ও সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চৌধুরী এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় পার্টির এ প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচনের আগের দিন হাটহাজারী গিয়ে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করেই চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। নগরের চট্টগ্রাম-৯ আসনের দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুর নির্বাচনী কাজে তিনি চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করেন। চট্টগ্রামে অবস্থানকালে সার্কিট হাউসে থাকেন তিনি। এরপর তিনি ঢাকায় চলে যান। সর্বদলীয় সরকারে মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি তিনবার এলাকায় যান বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
চট্টগ্রাম-১ মিরসরাই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। নির্বাচনের দিন তিনি এলাকায় ছিলেন না। নির্বাচনের দু'দিন আগে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিয়ে পরদিন ঢাকায় চলে যান। নির্বাচনের পরদিন সোমবার এলাকায় গেলেও গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে ফের ঢাকা গিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, 'এলাকার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আমি সুযোগ পেলেই এলাকায় ছুটে যাই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও এলাকার লোকজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে, কথাবার্তাও হচ্ছে।'
চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি আসনে তরীকত ফেডাশন সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী নির্বাচন করেন। মহাজোটের সমর্থন নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ড. মাহমুদ হাসানকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর দু'দিন এলাকায় থাকলেও তিন দিনের মাথায় তিনি ঢাকায় যান। এলাকায় অবস্থানকালে সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। এ সময় তার বাড়িতে ছিল উৎসাহী মানুষ ও ভক্তদের ভিড়। নির্বাচনের পরদিন উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী সমকালকে বলেন, 'আমি আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছি। আমার প্রথম কাজ হবে এলাকাবাসীকে নিয়ে ফটিকছড়ির সন্ত্রাস নির্মুল করা।'
নির্বাচনের পর শপথ গ্রহণের আগ পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান করেন চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত সাংসদ মাহফুজুর রহমান মিতা। নির্বাচনের পরদিন স্থানীয় মহিলা লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া সংবর্ধনা সভায় যোগ দেন তিনি। এলাকায় অবস্থানকালে কখনও গ্রামের বাড়ি বাউরিয়ায়, আবার কখনও বিভিন্ন এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও মতবিনিময় করেন তিনি।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ চৌধুরী ২৭ ডিসেম্বর চন্দ্রঘোনা এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে অংশ নেন। সরকারের মন্ত্রী পদে থাকায় ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত এলাকায় আসা-যাওয়া রয়েছে তার। নির্বাচনের পর সর্বশেষ গত গত ৮ জানুয়ারি তিনি এলাকায় যান। বাবা-মার কবর জেয়ারত ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে পুনরায় ঢাকা চলে যান। সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের শক্ত হাতে মোকাবেলা করাই তার প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে তিনি সমকালকে জানান।
চট্টগ্রাম-৮ বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইনউদ্দীন খান বাদল। আসনটিতে এটি তার দ্বিতীয় জয়। এমপির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বোয়ালখালী উপজেলা জাসদ সভাপতি মনছপ আলী সমকালকে জানান, নিয়মিতভাবে এলাকায় যান এমপি মইনউদ্দীন খান বাদল। এবার একক প্রার্থী হিসেবে জয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই নির্বাচনী এলাকা ঘুরে যান তিনি। মাঝে হঠাৎ তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য তিনি আমেরিকায় যান। আজ (রোববার) তার দেশে ফেরার কথা।
সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন এবার একক প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম-১০ হালিশহর-পাহাড়তলী আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও নির্বাচনের পর থেকে এলাকায় অবস্থান করার পাশাপাশি ঢাকায়ও তাকে থাকতে হয়েছে বলে জানান তার ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে পুনরায় জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী এমএ লতিফ। শুক্রবার তিনি সমকালকে বলেন, 'আমি সবসময় এলাকায় থাকি। নির্বাচনের পর বুধবার পর্যন্ত আমি আমার নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছি ও তাদের খোঁজখবর নিয়েছি। বৃহস্পতিবার সকালে শপথ নিতে আমি ঢাকা যাই।'
চট্টগ্রাম-১২ পটিয়া আসনে আবারও এমপি নির্বাচিত হয়েছেন শামসুল হক চৌধুরী। কিন্তু নির্বাচনের দিন রাতে ফলাফল ঘোষণার পরপরই চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন তিনি। সেখান থেকে গত ৭ জানুয়ারি ঢাকা গেলেও গত ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত এলাকায় যাননি তিনি। তবে অসুস্থ পিতাকে দেখতেই নির্বাচনের পরপর পটিয়া থেকে শহরে চলে আসেন বলে সমকালকে জানান তার ঘনিষ্ঠরা।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) আসনে আবারও এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। নির্বাচনের দিন ফলাফল নিয়ে আনোয়ারা ছেড়ে শহরে চলে আসেন তিনি। এ সময় এলাকার অনেক লোক ও দলের নেতাকর্মী নগরের সার্সন রোডের বাসায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। শপথ নিতে ৮ জানুয়ারি রাতে তিনি ঢাকায় চলে যান।
চট্টগ্রাম-১৪ চন্দনাইশ আসনে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম চৌধুরী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় নির্বাচন নিয়ে কোনো টেনশন ছিল না তার। তারপরও এলাকায় নিয়মিত আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন তিনি। গত ৭ জানুয়ারি চন্দনাইশের হারালায় অগি্নকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে নগদ টাকা, চাল ও শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। এর আগে ৩ জানুয়ারি সাতকানিয়ার কাটগড় এলাকায় পুড়ে যাওয়া একটি শিল্প কারখানাও পরিদর্শন করেন তিনি। কখনও চট্টগ্রাম শহরের বাসা থেকে চন্দনাইশে, আবার কখনও চন্দনাইশের বাড়িতে অবস্থান করে নেতাকর্মী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি।
আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই চট্টগ্রাম-১৫ লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আসনে এমপি নির্বাচিত হন আবু রেজা মো. নদভী। নির্বাচনের আগে প্রতিদিনই এলাকায় অবস্থান করে প্রচারণা চালান তিনি। নির্বাচনের পরও নিবিড় সম্পর্ক রাখছেন দলের নেতাকর্মী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে। শহরের বাসা থেকে প্রায় প্রতিদিনই সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় যান তিনি। যোগ দেন এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও।
জীবনে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে তিনি জাতীয় পাটির (জেপি) আ ন ম হায়দার আলীকে পরাজিত করে বিজয়ী হন।
গত মঙ্গলবার উপজেলার চাম্বল ডেপুটিঘোনা এলাকায় আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সমর্থকরা একে অপরের বাড়িতে পাল্টাপাল্টি আগুন দেওয়ার পর সেখানে যান মোস্তাফিজুর রহমান। নির্বাচনের পরের দু'দিন এলাকায় অবস্থান করে চট্টগ্রাম শহরের বাসায় চলে আসেন তিনি। এর পর থেকে চট্টগ্রাম শহরের বাসা ও বাঁশখালীর বাড়িতে আসা-যাওয়ায় ছিলেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.