পাকিস্তানে দেখা বাংলাদেশের বিজয় দিবস by জিয়াউল হক মুক্তা

২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ট্রাকভর্তি বিস্ফোরক দিয়ে ইসলামাবাদের ম্যারিয়ট হোটেলে হামলা চালিয়েছিল চরমপন্থি মুসলিম জঙ্গিরা। ঘটনাচক্রে সেখানেই আমার অবস্থান এবারের বিজয় দিবসে, পাকিস্তানিদের ভাষায় ঢাকা পতন দিবসে; দক্ষিণ এশিয়ার সংসদ সদস্যদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী কয়েকটি দেশের সংসদ সদস্য ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে যান পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে। সেখান থেকে ফিরে সন্ধ্যায় ভারত-পাকিস্তানের বন্ধুরা আমাকে বললেন, তাদের ভ্রমণের সময় পাকিস্তান সংসদে চলছিল বাংলাদেশবিষয়ক আলোচনা। কাজের চাপে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত আমার খুব একটা সময় ছিল না বিষয়টির বিস্তারিত খোঁজ নেওয়ার। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকা দেখে চক্ষু চড়কগাছ; দৈনিক পত্রিকা দি নেশন পুরো পাতাজুড়ে হেডলাইন করেছে :ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ওয়ার্নস বাংলাদেশ এগেইনস্ট 'রিসারেকটিং ১৯৭১'। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পত্রিকাটির পুরো সংবাদটির ছবি দিয়ে একটি পোস্ট দিলাম; পরে চেক করে দেখেছি ১৫০ জন তা শেয়ার করেছে তাদের নিজ নিজ নেটওয়ার্কে। এভাবে ডিজিটাল গণমাধ্যম আমাদের সংগ্রামের প্রয়োজনীয় উপকরণ আজকের দিনে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর কথা হলো পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য রমেশ সিং আরোরার সঙ্গে; কিছুক্ষণ পরই জলবায়ুতাড়িত অভিবাসন বিষয়ে আয়োজিত একটি অধিবেশনে আমি মূল বক্তা আর তিনি আলোচক, যার সভাপতি পাকিস্তান আওয়ামী জামহুরি পার্টির নেতা আবরার কাজী। রমেশ সিং আরোরা জানালেন, ১৯৪৭ সালের পর তিনিই পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম শিখ সদস্য। তার সঙ্গে অনেক কথা হলো পাকিস্তান সংসদের প্রস্তাব নিয়ে। আমি বললাম, পাকিস্তানের তরুণদের অনেক ভুল ধারণা আছে বাংলাদেশের উদ্ভব নিয়ে এবং একইভাবে বাংলাদেশের তরুণদের অনেক ভুল ধারণা আছে পাকিস্তান বিষয়ে; এগুলো দূর করা দরকার। তাকে বললাম, বাংলাদেশ যে পাকিস্তানের অংশ ছিল ২৩ বছর_ তা বাংলাদেশের ধারাবাহিক ইতিহাসের একটি সাময়িক ছেদ মাত্র; তা বাংলার জনগণের দীর্ঘ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ফল নয়; সুতরাং পাকিস্তানের তরুণদের এটা ভাবা উচিত নয় যে, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়; যে সময়টুকু বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল, সেটুকু ছিল পাকিস্তানের জন্য বোনাস_ তাই পাকিস্তানি তরুণদের মন খারাপ করার কিছু নেই। বাংলা ও পাঞ্জাবের জনগণ উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য ছিল সবচেয়ে অগ্রগামী দুটো জাতি, ভারতীয় জাতিগুলোর মধ্যে কেবল তারাই সবচেয়ে জঙ্গি সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে: তাদের লক্ষ্য ছিল সব জাতির স্বাধীনতা ও ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা। সে জন্যই বাংলাদেশের সূর্য সেন ১৯৩০ সালে যুদ্ধ করে স্বাধীন চট্টগ্রাম প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন; সে জন্যই পাঞ্জাবের ভগৎ সিং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করেছিলেন; এবং সে জন্যই ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। তিনি একমত হলেন; বললেন :হ্যাঁ, তাই তো; আমরা তো ভারত বা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করিনি।
পাকিস্তানের প্রধানতম একটি থিংকট্যাঙ্ক এসডিপিআইর বন্ধু ড. আবিদ সুলেরি জানালেন, পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সদস্যের অনুপস্থিতির একটি অধিবেশনে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ একটি সুযোগ নিয়েছে; যদিও জামায়াতে ইসলামী উত্থাপিত সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও মুত্তাহিদা কওমি পার্টি। সন্ধ্যায় সিন্ধু প্রদেশের বন্ধু জুলফিকার হালেপোটো জানান, সামাজিক গণমাধ্যমে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী নাগরিকরা সংসদের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানাচ্ছেন। মাঝরাতে তিনি ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেন, টেলিভিশনের টকশোগুলোতেও একই অবস্থা। অতীতে তিনি বহুবার জানিয়েছেন, পাকিস্তানের অধিকাংশ জাতিসত্তার জনগণের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক অমিত প্রেরণার আধার। তিনি অনেকের সঙ্গে আমাকে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছেন যারা ভাবেন তারই মতো করে। তাদের সঙ্গে পাকিস্তানে আমার সময় কাটে সমাজবিজ্ঞানের একজন অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের মতো।
অনুষ্ঠানের শেষদিন ১৮ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা; মিডিয়া ব্রিফিং শেষে লোকজনের উপস্থিতি অনেক কম। কোনো একটি গণমাধ্যমের একজন কর্মী আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। আমি সম্মতি দিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিল। তার মুখের ভাষা ছিল স্বাভাবিক কিন্তু দৃষ্টি ও শারীরিক ভাষা ছিল ভীষণ আক্রমণাত্মক; ফলে কয়েক মিনিটেই আমি সাবধান হয়ে গেলাম_ ছাত্রজীবন থেকে জামায়াত-শিবিরের আচরণ ও ভাষা আমার পরিচিত_ তাকে আমার পাকিস্তান জামায়াতের কর্মীই মনে হলো। ভারতের বন্ধু সঞ্জয় ভাশিস্তের কাছে গিয়ে আমার দিকে নজর রাখতে বলে ফিরে গেলাম ওই সাংবাদিকের কাছে। সেও মনে হয় বুঝতে পেরেছে আমার মনোভাব; তার শেষ উদ্ধত মন্তব্য ছিল_ বাংলাদেশ নাকি একটি ত্রিদেশীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে যুদ্ধাপরাধের বিচার না করার অঙ্গীকার করেছিল_ বাংলাদেশ কেন সেই চুক্তি ভঙ্গ করছে?
২১ ডিসেম্বর দুপুরেই ইসলামাবাদে আমার সব কাজ শেষ। বিকেলে গেলাম এসডিপিআই কার্যালয়ে দুটো বই সংগ্রহ করতে। একটি, 'রিকনস্ট্রাকটিং হিস্টরি : মেমোরিজ, মাইগ্র্যান্টস অ্যান্ড মাইনরিটিস' এবং 'দি ল্যান্ড অব টু পার্টিশনস অ্যান্ড বিয়োন্ড'। দুটোই সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন এসডিপিআই-এর উর্দু বিভাগের গবেষক কবি আহমদ সলীম। দুটো প্রকাশনাতেই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক গৌরবজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনার রয়েছে আদ্যোপান্ত বিবরণ। পাকিস্তানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ভেতরই ইতিহাস পুনর্নির্মাণের এই অসাধারণ উদ্যোগে আমি অভিভূত। ড. আবিদ সুলেরি আমাকে বললেন, আপনার উচিত আহমদ সলীমের সঙ্গে দেখা করা। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি_ তাকে খোঁজ নিতে বললাম তাকে তার বাসায় পাওয়া যাবে কি-না। তিনি জানালেন, বিকেল ৪টার পর তাকে বাসায় পাওয়া যাবে। বাসায় পেঁৗছতেই সবার আগে কবি আহমদ সলীম আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন আরও দুটো বই, 'মাই বাংলাদেশ ডেইজ' এবং 'উই ও অ্যান অ্যাপোলোজি টু বাংলাদেশ'। দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে গত বছর; এতে রয়েছে বাংলাদেশে পাকিস্তানের কৃত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রতিবাদের ঐতিহাসিক সব দলিল, রচনা ও ক্ষমা প্রার্থনা। এসডিপিআই কার্যালয়ে আগেই দেখেছি, এ বছর আহমদ সলীমকে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় সম্মাননার স্মারকটি। তার কাছে জানলাম, ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে তার ক্যান্সার আক্রান্ত লিভার প্রতিস্থাপন হওয়ায় মার্চে তিনি বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকা আসতে পারেননি; তার হয়ে এসেছিলেন একজন বন্ধু-সহকর্মী। কবি জানালেন, একাত্তরের মার্চের ২৭ তারিখে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন, যা পরে প্রকাশিত হয়েছিল একটি পত্রিকায়, সেই অপরাধে তিনি অন্তরীণ হয়েছিলেন জেলে। তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর, ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি। তার কাছে জানতে চাইলাম যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তরুণদের সাম্প্রতিক আন্দোলন-সংগ্রাম বিষয়ে। অল্প কথায় তিনি বললেন, 'হোয়াট দে আর ফিলিং, হোয়াট দে আর ডুয়িং, আর জাস্টিফাইড।'
জাতীয় কৃষক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ

No comments

Powered by Blogger.