বাংলাদেশে প্রথম সকাল by জয় হ্যাম্পটন

আমাদের ওকলাহোমা প্রতিনিধি দলটি বিভিন্ন প্লেনে কয়েক ঘণ্টার কষ্টকর ভ্রমণ শেষে বাংলাদেশে পেঁৗছতে পারি। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের লাগেজ, অন্তত বেশিরভাগই আমাদের সঙ্গে পেঁৗছায়নি। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা এরই মধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ও মিডিয়ার কয়েকজন আমাদের শুভেচ্ছা জানান। দুই ভদ্রলোক আমাদের মালপত্র খুঁজে পেতে এবং শুল্ক বিভাগের মধ্য দিয়ে তা বের করে আনতে সহযোগিতায় ছিলেন। অবশ্য লাগেজ না থাকায় শুল্ক বিভাগের কাজই ছিল না। দীর্ঘ সময়ের কাগুজে কর্ম সম্পাদন করে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা পরিধানের জন্য কিছু কিনতে আমাদের প্রত্যেককে স্বল্প নগদ টাকা দিলেন, প্রত্যেককে ৩ হাজার ৮৭০ টাকা বা প্রায় ৫০ ডলার করে। আমাদের অনেকেরই কেবল কাঁধের ব্যাগে কিছু কাপড় ছিল, যেহেতু শিকাগোতে আমাদের বড় ব্যাগ চেকিংয়ের মধ্য দিয়ে যায়।
আমাদের বাংলাদেশি বন্ধুরা আমাদের ফুল ও পানির বোতল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। তারপর একটি মিনি ভ্যানে করে শশব্যস্ত শহরের মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে প্রায় সব পাবলিক বাসের বিভিন্ন পাশ চ্যাপ্টা লেগে আছে, আঁচড় পড়েছে এবং কাচ ভাঙা। গাড়িগুলো রাস্তায় খুব কাছাকাছি দূরত্ব রেখে চলছিল, যা আসলে গাড়ির গায়ের আঁচড়গুলোর ব্যাখ্যা দেয়। গাড়িগুলো টানা হর্ন বাজাচ্ছিল। আমাদের চালক খুব দ্রুত এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যানজটের মধ্য দিয়েই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জানালেন, অন্য দিনের মতো যানজট এতটা খারাপ নয়, যেহেতু বয়কট ও অবরোধ চলছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কোনো নিদর্শন আমরা দেখতে পাইনি। জনসাধারণ খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ, উৎসাহী ও সহায়তাপ্রবণ ছিল। ৫ জানুয়ারির আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সূত্রপাত হওয়া অভ্যন্তরীণ শত্রুতা সহিংসতার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই অবস্থা আমাদের মতো আমেরিকানদের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। রক্ষণশীল ধর্মীয় বিরোধী দল মনে করছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এবং এজন্য প্রতিবাদ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ তুলনামূলক নতুন একটি দেশ। একসময় ভারতের অংশ এবং ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত ছিল। ইংরেজি এখনও কমন ভাষা হিসেবে রয়ে গেছে। তারা রাস্তার বাম সাইড ধরে গাড়ি চালায়। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার। যদিও দেশটি একটি ইসলামিক দেশ। জনসংখ্যার ছোট একটি অংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের, তার চেয়ে ছোট অংশ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মাধ্যমে এটি শুরুতে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশটির পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মাঝে ভারতের অবস্থান ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত, একই ভাষা ছিল না। এই দুই অংশের সাংস্কৃতিক পার্থক্যও ছিল। এজন্য এবং আরও কিছু কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হয়।
ঢাকা, যেখানে বর্তমানে আমরা থাকছি, দেশটির রাজধানী এবং প্রায় ১৯ মিলিয়ন লোকের আবাসস্থল। তারা বন্ধুত্বপূর্ণ, এমনকি রাস্তায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও। এখানে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির বাস রয়েছে, এমনকি মাঝেমধ্যে ব্রিটিশ স্টাইলের ডাবল ডেকার চলতেও দেখা যায়। ট্যাক্সিও কয়েক ধরনের রয়েছে। সামনের এক চাকা ও পেছনের দুই চাকা নিয়ে ছোট একধরনের ট্যাক্সি রয়েছে। এসব ট্যাক্সির শরীর সবুজ রঙে রাঙানো। এই সবুজ রঙ হয়তো বোঝায় একসময় বেবিট্যাক্সি নামে পরিচিত গাড়িগুলো পরিবেশবান্ধব যেহেতু এগুলো সিএনজি দিয়ে চালিত হয়। রাস্তায় বাইসাইকেল চলতে দেখা যায়। নকশা করা রিকশাগুলো এক থেকে চারজন যাত্রী বহন করে। অনেক সময় যাত্রীরা একে অপরের কোলেও বসে থাকে। জনসাধারণ বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেলও চালায়। এ দুটিতেই একের অধিক যাত্রীর দেখা পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাইসাইকেলগুলো অনেক সময় মালামাল টানতেও ব্যবহৃত হয়। রাস্তায় দামি দামি গাড়ি দেখাও কোনো অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়।
রাস্তাগুলোতে নির্দিষ্ট কোনো লেন নেই। ট্রাফিক সার্জেন্ট যখন একসঙ্গে সব গাড়ি ছাড়ে তখন গাড়িগুলো জায়গা তৈরি করেই সামনের দিকে যায়। এক্ষেত্রে দেখা যায় রিকশা ও সাইকেলকে মোটরচালিত গাড়িগুলোকে জায়গা করে দিতে হয়। রিকশাচালকরা দেখতে হালকা-পাতলা কিন্তু মাংসপেশিবহুল। তারা প্যাডেল দিয়ে বেশ দ্রুতগতিতে যানজটের ভেতর রিকশা চালিয়ে নিয়ে যায়। তাদের খুব কম অংশই মুখবন্ধনী পরিধান করে, যদিও তাদের যানজটের সময় গাড়ির ধোঁয়ার মধ্যে থাকতে হয়।
রাস্তার পাশে এবং মোড়গুলোতে বিভিন্ন রকমের পোশাকের মানুষ দেখা যায়, প্রথাগত মুসলিম পরিবার থেকে আসা নারীদের সুন্দর শাড়ি পড়তে দেখা যায়, আবার অনেক পুরুষই পশ্চিমা স্টাইলের পোশাক পরিহিত থাকে। বাংলাদেশ সংকটময় অর্থনীতির একটি পরিদৃশ্য, যেখানে একদিকে রয়েছে পুরনো সুউচ্চ বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট, ঠিক তার পাশেই হয়তো চকচকে নতুন ভবন। সবখানেই নির্মাণ কাজ চলছে, কিন্তু কিছু বিল্ডিং দেখতে খুবই খারাপ। ঢাকায় ভবনগুলোর বারান্দায় বিভিন্ন রঙের কাপড় ঝুলতে দেখেই বোঝা যায় এগুলো এরই মধ্যে পরিপূর্ণ। ১৯ মিলিয়ন লোককে কোথাও না কোথাও তো থাকতে হবে।
কিছু জায়গায় রাস্তার পাশে লাইন ধরে ঢেউতোলা টিনের ছোট ছোট ঘর দেখা যায়। দিনের বেলায় স্টলগুলোতে ফল, রুটি, কাপড় কিংবা অন্যান্য পণ্য বিক্রি করতে দেখা যায়। রাত হলেই ছোট্ট জায়গা হয়ে আবাস হয়ে যায়। এই দরিদ্রতার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় রঙিন বিলবোর্ড দেখা যায়। এটি শহরের বিজ্ঞাপনের বিলাসিতা তুলে ধরে, যেখানে হয়তো অনেকেই ঠিকমতো খেতে পারছে না। ঢাকায় এসে 'জীবনের পরিপূর্ণতা' কথাটার নতুন মানে খুঁজে পেলাম। আমি তা উপলব্ধি করতে পারি নাড়ির স্পন্দনের মতো। টিকে থাকার তীব্র আকুতি ও অন্তরে উন্নতিলাভ করার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মানবতা বেঁচে আছে। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই এখনও খুব প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু তারপরও, এসব মানুষ প্রফুল্ল, এমনকি আশাবাদীও।
সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার নরম্যান ট্রান্সক্রিপ্ট, যুক্তরাষ্ট্র

No comments

Powered by Blogger.