মহানায়িকার জন্য শুভকামনা

(সুচিত্রা সেন) বাংলা চলচ্চিত্রের 'মহানায়িকা' সুচিত্রা সেনের শারীরিক অবস্থার অবনতিতে যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, তা স্বভাবতই সীমানা মানেনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যেমন ছুটে গিয়েছেন, সীমান্তের এপাশ থেকে আরোগ্য কামনা করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। দুই বাংলার সাধারণ মানুষও কতটা উদ্বিগ্ন, সেই ছাপ দুই পাশের সংবাদমাধ্যমে স্পষ্ট। আমরা চাই, তিনি দ্রুতই আরোগ্য লাভ করুন। জীবন্ত এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রে ফিরবেন না জানা কথা; কিন্তু নিজের পরিসরেই তিনি সুস্থ থাকুন_ আমরা সেটাই কামনা করি। আমরা তার অতীতেই মগ্ন থাকতে চাই; কিন্তু তার নিজের বর্তমান যেন উপভোগ্য থাকে। আমরা জানি, রমা দাসগুপ্তা থেকে সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠার ভ্রমণটা কতটা চমকপ্রদ। ২১ বছর বয়সে রমা নাম নিয়ে এসেছিলেন চলচ্চিত্র জগতে, তারপর সুচিত্রা নামে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। অসামান্য অভিনয় প্রতিভায় এখন তিনি কোটি কোটি মানুষের কাছে সুচিত্রা নামেই পরিচিত। চলচ্চিত্রের রূপালি জগৎ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়ে লোক অন্তরালে চলে যাওয়ার পরও তিনি মহানায়িকা। এখনও কোটি কোটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে তিনি। সৌন্দর্য আর প্রতিভার মিশেলে সমৃদ্ধ করেছেন চলচ্চিত্র জগৎকে। মূলত টালিউডের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন। অল্প কয়েকটি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। কিন্তু তার সুখ্যাতি কেবল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ঘিরে আবর্তিত হয়নি। বরং তিনি স্থান পেয়েছেন এপার ও ওপার বাংলার মানুষের মনের মুকুরে। মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ১৯৫২ সালে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেছিলেন 'শেষ কোথায়' ছবির মাধ্যমে। ছবিটি মুক্তি পায়নি। পরের বছরেই অভিনয় করেন আলোচিত 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে। বিপরীতে মহানায়ক উত্তমকুমার। এক লহমাতেই যেন যুক্ত হয় বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন ইতিহাস। কিংবদন্তিতুল্য হয়ে ওঠে উত্তম-সুচিত্রা জুটি। এই জুটির শেষ চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল আজ থেকে ৪৬ বছর আগে, ১৯৬৭ সালে (গৃহদাহ)। এত বছর পরে এখনও বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে পরিচিত উত্তম-সুচিত্রা। উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন নাম দুটি পাশাপাশি উচ্চারিত হলেই মনে করিয়ে দেয় বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি সময়ের কথা। সুচিত্রা সেন হয়ে উঠেছিলেন রোমান্টিক নায়িকার আইকন। সুচিত্রা সেন প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে দেবদাস ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্র থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে সাড়ে চুয়াত্তর, অগি্নপরীক্ষা, সাগরিকা, হারানো সুর, দীপ জ্বেলে যাই, সপ্তপদী, সাত পাকে বাঁধা, সূর্য তোরণ, দেবী চৌধুরাণী। আমরা দেখতে পাই, চলচ্চিত্রের অনেক বিখ্যাত নায়িকা পরবর্তীকালে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু সুচিত্রা সেন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মহানায়িকা হিসেবেই তিনি অবসর নিয়েছেন। ফলে কোটি কোটি দর্শকের মনের চিত্রপটে এখনও তিনি মহানায়িকা হিসেবেই রয়ে গেছেন। ১৯৭৮ সালের পরে তিনি আর কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি। চলে গিয়েছিলেন লোক অন্তরালে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি যাপন করছেন এক রহস্যময় জীবন। পর্দার আড়ালে গিয়ে অন্য এক যাপিত জীবনের বাসিন্দা হলেও নানা প্রজন্মের কোটি কোটি দর্শকের হৃদয় থেকে নিজেকে আড়াল করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সুচিত্রা সেন পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা পেলেও তার জন্মস্থান বাংলাদেশের পাবনা। তিনি হয়ে উঠেছিলেন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মিলনসেতু। গত ২৫ ডিসেম্বর শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে। আমরা আশা করব মহানায়িকা সুস্থ হয়ে উঠবেন। সুচিত্রা সেন ভাস্বর হয়ে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

No comments

Powered by Blogger.